মহিউদ্দিন রাব্বানি
১৭ মার্চ ২০২৫, ১২:৫৩ পিএম
রাজধানীতে যানজট সমস্যা দীর্ঘদিনের। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এই সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। ঢাকার সব রুটেই জট লেগে থাকে প্রতিনিয়ত। তবে সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী যেন ঢাকার দুঃখ! নানা অব্যবস্থাপনায় মারাত্মভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের যাত্রীসেবা। যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা ও পার্কিংয়ে ভেঙে পড়েছে পুরো টার্মিনালের শৃঙ্খলা। যাত্রাবাড়ী থেকে টিকাটুলি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সড়ক আন্তঃ ও দূরপাল্লার গাড়িতে ঠাসা থাকে সব সময়। পাশাপাশি ফুটপাত ও সড়কের বড় একটি অংশ দখলে রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের।
সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুর রুটের বাস ছেড়ে যায় সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে। পদ্মা সেতু চালুর পর বদলে যায় এই টার্মিনালের চিত্র। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলগামী শত শত বাসও যুক্ত হয়েছে সায়েদাবাদের এই টার্মিনালে। এমনিতে এই টার্মিনালের অবস্থা নাজুক, তার ওপর বাড়তি গাড়ির চাপে ভেঙে পড়ে পরিবহন শৃঙ্খলা। এরপর উন্নত, আধুনিক ও বিশ্বমানের টার্মিনাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। পতিত সরকারের সময়ে তৎকালীন মেয়র ফজলে নূর তাপস টার্মিনাল সংস্কারে ৩০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করলেও কার্যত টার্মিনালের দৃশ্যমান শৃঙ্খলার কোনো উন্নতি হয়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ী মোড় থেকেই যানজটের শুরু। পঞ্চমুখী এই রাস্তায় এলোপাতাড়ি বাস, রিকশা ও লেগুনা চলাচল করছে। পথচারীদের রাস্তা পারাপারে নেই কোনো ফুটওভার ব্রিজ। ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়েই রাস্তা পারাপার করছের পথচারীরা। যাত্রাবাড়ী মোড়ে একদিকে গুলিস্তান, মিরপুর, গাবতলী রুটের গাড়ি এসে জমা হয়। থানার পেছন দিক থেকে ডেমরা রুটের গাড়ি, দয়াগঞ্জ হয়ে সদরঘাটের লেগুনা, পদ্মার ওপাশ থেকে ছেড়ে আসা গাড়িসহ চট্টগ্রাম-সিলেটের শত শত গাড়ি এসে জট লেগে যায় এখানে। পাশাপাশি রয়েছে রিকশা-লেগুনা স্ট্যান্ড।
ফলে জট পার হয়ে দূরপাল্লার গাড়িগুলো সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে ঢুকতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় যাত্রীদের। অন্যদিকে চট্টগ্রাম, সিলেট ও পদ্মা সেতুগামী পরিবহন টার্মিনাল থেকে সময় মতো ছেড়ে যেতে পারে না।
সিলেটগামী এনা পরিবহনের ড্রাইভার জসিম উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, সায়দাবাদের এই জ্যাম ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। কোনো পরিবর্তন নেই। টার্মিনাল থেকে যাত্রাবাড়ী পার হতেই এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় গেলে যায়। আবার ঢাকায় ঢুকতে কখনো কাঁচপুর থেকে আবার কখনও কাজলা থেকে জ্যামে পড়ে যাই। তবে যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদের দুর্ভোগ থেকে রেহাই পায় হানিফ ফ্লাইওয়ার দিয়ে যাতায়াত করা পরিবহনগুলো।
সায়েদাবাদ ও আশপাশে ঘুরে দেখা যায়, দূরপাল্লার বাসগুলো সায়েদাবাদ রেল ক্রসিং ও জনপদের মোড়েই টার্ন করে। ফের যাত্রীর জন্য হাঁকডাক করতে থাকেন হেলপার ও সুপারভাইজাররা। যখন বাস ঘোরানো হয় তখনই পুরো সড়কজুড়ে জট লেগে যায়। এছাড়া রুট ক্রস করছে যে যার মতো করে। ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা সদস্যরা নির্বিকার। ট্রাফিক পুলিশের তিন সদস্যদের দেখা গেছে ফ্লাইওভারের নিচে খোশগল্প করতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্রাফিক সদস্য বলেন, আমাদের লোকবল কম। কয়েকজন লোক দিয়ে পুরো এলাকা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। গাড়ির চাপে আমরা অসহায় ও অপারগ হয়ে যাই।
শ্যামলী পরিবহনের শ্রমিক লোকমান মিয়া বলেন, পুরো ঢাকার সব বিশৃঙ্খলা এখন সায়েদাবাদে। হাজার হাজার গাড়ি সামাল দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। আর এত গাড়ি রাখার জায়গাও নেই টার্মিনালে। ফলে গাড়িগুলো পড়ে থাকে রাস্তাজুড়ে।
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রশাসনের পক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও কার্যত সুফল পাচ্ছে না যাত্রীরা। রাজধানীতে যানজট সমস্যা দীর্ঘদিনের। এই যানজটের কারণেই নগরবাসীর নষ্ট হচ্ছে দৈনিক কর্মঘণ্টা। ভোগান্তি নিরসনের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসে না। যানজটের এই জটিল সমস্যা থেকে সমাধানের পথ খুঁজতে রাজধানীর ভেতরের তিনটি বাস টার্মিনাল সরানোর ব্যাপারে একমত সবাই। এছাড়া ট্রাক টার্মিনালের জন্য পৃথক স্থান নির্ধারণ করা হয়।
জানা গেছে, সায়েদাবাদ, মহাখালী ও গাবতলী টার্মিনালের মাত্র ৮০০ থেকে ১০০০ বাসের ধারণক্ষমতা রয়েছে। ঢাকা শহরের ভেতরে বাস রুট পুনর্বিন্যাস কমিটির তথ্য অনুযায়ী, এই তিন টার্মিনালে এখন ১০ হাজারের ওপর বাস রাখা হয়। আরও কয়েক হাজার বাস টার্মিনালের আশপাশের রাস্তায় পার্কিং করা হয়। এতে যানজটের সৃষ্টি হয়।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের তথ্যমতে, রাজধানীর যানজটের দুর্ভোগ কমাতে গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী থেকে বাস টার্মিনাল সরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এগুলোর পরিবর্তে রাজধানীর প্রবেশপথে কেরানীগঞ্জের বাঘাইর, সাভারের হেমায়েতপুর ও বিরুলিয়া, নারায়ণগঞ্জের ভুলতা, কাঁচপুর সেতু ও কাঁচপুরের মদনপুরে ৬টি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে।
অগ্রাধিকারভিত্তিতে কাঁচপুর উত্তর (কাঁচপুর ব্রিজ সংলগ্ন স্থান) ও কাঁচপুর দক্ষিণে (মদনপুর) টার্মিনাল নির্মাণের কাজ আগেই শুরু করা হয়েছে। বাকি পাঁচটি টার্মিনালের কাজও রয়েছে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে। কাঁচপুর উত্তরে আন্তঃজেলা টার্মিনালের সঙ্গে লোকাল বাসের ডিপোও হবে। এছাড়া পূর্বাঞ্চলের কাঞ্চন এবং কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজারের ভাওয়াল এলাকায় লোকাল বাস ডিপো হবে। আশুলিয়ার বাইপাইল ও গাজীপুরে হবে বাস ও ট্রাকের ডিপো।
তথ্য মতে, সড়কপথে ঢাকার সঙ্গে দেশের ৬৩টি জেলার যোগাযোগ হয় ছয়টি মহাসড়কে। যেসব স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে, সেখানে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে মহাসড়কে সরাসরি উঠবে গাড়ি। যানজট কমাতে ঢাকা শহরের বাইরে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল স্থানান্তরের যে পরিকল্পনা সরকার করছে, তা বাস্তবায়নে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা লাগবে।
সায়েদাবাদের টার্মিনাল কাঁচপুরে স্থানান্তরের কাজ কতটুকু সম্পন্ন হয়েছে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্থপতি ও প্রধান পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল কাঁচপুরে স্থানান্তরে কাজ চলমান। যতটুকু জানি কাজ প্রায় শেষের দিকে। কাজ শেষ হলেই কাঁচপুর চালু হবে। ঢাকার জট কমে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা জটিলতার ফাঁদে নাগরিক সেবা। অবৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে ভরা সেবা প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ। ফলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না। নাগরিক ভোগান্তিও কমছে না।
যাত্রীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, আসলে সড়কে শৃঙ্খলার দায়িত্ব কারা পালন করবেন এটা আগে ঠিক করতে হবে। ট্রাফিকের কাছে কোনো ম্যাকানিজম নেই। বিআরটিএ সব সময় লোকবল সংকট দেখায়। প্রকৃতপক্ষে গবেষণা দরকার। নগর পর্যবেক্ষণ করে ছোট ছোট সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পথ বের করতে হবে। অথচ ট্রাফিকে এগুলো নেই।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ও পরিববহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রশাসন নানা উদ্যোগ নিলেও যারা রাস্তা দখল করে আছে তাদের কথা কেউ বলে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে আমরা সুফল পাচ্ছি না।
বিআরটিএ’র সমালোচনা করে তিনি বলন, বিআরটিএ একটি অপেশাদার প্রতিষ্ঠান। বিআরটিএতে টেকনিক্যাল লোক নেই। স্বচ্ছতা ও জবাবদিতা নেই। দায়িত্বে জায়গায় দায়িত্বের অযোগ্যদের দিয়ে ভরে দেওয়া হয়েছে। ফলে আমরা এখনো সুশৃঙ্খল পরিবহনব্যবস্থা পাইনি। এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার জরুরি। অবৈজ্ঞানিক কাজ করলে হবে না। পরিস্থিতির উন্নতিও হবে না। আমরা ধীরগতির শহরে শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছি তাতে কারো কিছু আসে যায় না।
গণপরিবহন শৃঙ্খলার বিষয়ে তিনি বলেন, গণপরিবহন একটি দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ফুটপাতকে পথচারীদের চলাচলের যোগ্য করে তুলতে হবে। করিডোরভিত্তিক রুট চালু করতে হবে। যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধ করতে হবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, যানজটের ভোগান্তি রাজধানীবাসীর নিত্যসঙ্গী। প্রতিনিয়ত ঢাকামুখী মানুষের জনশ্রোত লক্ষ্য করা যায়। এই জনস্রোত ঢাকাবিমুখী করতেই হবে। তার আগে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত আমরা ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করব কি-না। ঢাকাকে ডিসেন্ট্রালাইজেশন বা বিকেন্দ্রীকরণের যে নীতি সে বিষয়ে এখনো যদি না ভাবি, দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাবে। আমরা হয়ত আরও অবকাঠামো উন্নয়ন, আরও ফ্লাইওভার, আরও মেট্রোরেল করব, এতে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু এই স্বস্তিটা দীর্ঘমেয়াদি হবে না। আমরা যাদি জনস্রোত নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, ঢাকা বিমুখী করতে না পারি, তাহলে লাভ হবে না। ঢাকা শহরে যেসব প্রতিষ্ঠান থাকার দরকার নেই এমন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আছে- এগুলোকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। যানজটের যে সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে তাও বিকেন্দ্রিকরণ করতে না পারলে সম্ভব হবে না।
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ঢাকার টার্মিনাল স্থানান্তরের বিষয়ে আমি একমত না। যখন টার্মিনালগুলো ঢাকার বাইরে নিয়ে যাবে তখন ঢাকায় প্রবেশের জন্য আরও ছোট ছোট যানবহনের সংখ্যা বাড়বে। ফলে যানজটের সঙ্গে যুক্ত হবে দুর্ঘটনাও। আমাদের এখনই বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে- আমরা আসলেই বিকেন্দ্রীকরণের দিতে যাব কি না। আমাদের আশপাশে অনেক দেশেই এই কাজ করেছে। ভারত তিন বার রাজধানী পরিবর্তন করেছে। পাকিস্তান, মালয়েশিয়ায় পরিবর্তন হয়েছে। ঢাকা শহরে বিনিয়োগ না করে ঢাকার বাইরে বিবিয়োগ করেন, কর্মসংস্থান করেন, যেন তারা ঢাকার বাইরে থাকতে পারে। তাদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করেন। তাহলে জনস্রোত ঢাকাবিমুখী হবে।
এমআর/জেবি