images

জাতীয়

‘অপারেশন ডেভিল হান্টে’র এক মাসেও স্বস্তি ফেরেনি

ঢাকা মেইল ডেস্ক

০৮ মার্চ ২০২৫, ১১:০২ এএম

images

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অব্যাহত অবনতির মুখে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামের সেনা-পুলিশের বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়েছিল এক মাস আগে। আজ শনিবার (০৮ মার্চ) যখন এই অভিযানের এক মাস পুরো হচ্ছে, তখন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য কতটুকু পূরণ হয়েছে, তা নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। জেলায় জেলায় অভিযান চলানোর পরও দেশের আইনশৃ্ঙ্খলা পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি বলে জানাচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

বরং অভিযান চলার মধ্যেই একের পর এক ডাকাতি, প্রকাশ্যে অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাই, গণপিটুনি দিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, ‘তৌহিদী জনতার’ ব্যানারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাধা, মব সৃষ্টি করে বাড়িঘরে হামলা-লুটপাট, এমনকি পুলিশের ওপর হামলার মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। এর মধ্যেই আবার ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া অঞ্চলে চরমপন্থীদের তৎপরতা বাড়তে শুরু করেছে।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাইদুর রহমান বলেন, এসব ঘটনায় কমে আসার পরিবর্তে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-আতঙ্ক অনেকক্ষেত্রে আরও বেড়েছে বলেই আমরা জানতে পারছি।

সার্বিক বিবেচনায় প্রথম মাসে ‘অপারেশন ডেভিল হান্টে’ আশানুরূপ সফলতা দেখা যায়নি বলে মনে করছেন মানাবাধিকার কর্মীদের অনেকে। মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, সার্বিক মূল্যায়নে অভিযানটিকে এখন পর্যন্ত খুব একটা সফল বলা যাচ্ছে না। সফলতা যেভাবে আশা করা হয়েছিল, সেভাবে হচ্ছে না ।

এদিকে, অভিযানে গ্রেফতারদের মধ্যে বড় অংশই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বলে জানা যাচ্ছে, যা নিয়ে প্রশ্নও উঠছে। তবে সরকার বলছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, অন্যায়ভাবে কাউকে ধরা হয়নি। যার নামে মামলা আছে, তাকে তো অবশ্যই ধরতে হবে।

তিনি আরও বলেন, তারা (আওয়ামী লীগ) যে ষড়যন্ত্র করছে, এটা তো স্পষ্ট। তারা ডেভিল অ্যাক্টিভিজম করছে বলেই তো ডেভিল হান্টের প্রয়োজন পড়লো।

4

উল্লেখ্য, গত সাতই ফেব্রুয়ারি রাতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলার শিকার হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। ওই ঘটনায় গুরুতর আহত একজন পরে মারাও যান। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই ওই হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগিরা। এ ঘটনার পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের দাবির মুখে আটই ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী শুরু হয় ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। বিশেষ এই অভিযানে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার ১১ হাজারের বেশি। একই সময়ে নতুন-পুরাতন বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হয়েছে অন্তত ২০ হাজার।

আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে?

‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামেরই অভিযান অব্যাহত রাখা হলেও দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না; বরং মানুষের মাঝে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে- এমনটা বলছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাইদুর রহমান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ অভিযান শুরু করার পরেও গত একমাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। উপরন্তু অভিযানের মধ্যেই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ এবং গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে, ফ্রেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরুর আগের মাস, অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে দেশে যেখানে ৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল, ফেব্রুয়ারিতে সেটি বেড়ে ৫৭-তে এসে ঠেকেছে। এর মধ্যে অন্তত দুই জন নারী ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।

বেড়েছে দলবেধে ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার সংখ্যাও। জানুয়ারিতে দলবেধে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ১৫টি, যা ফেব্রুয়ারিতে এসে ১৭ হয়েছে। একই সময়ে, ধর্ষণ চেষ্টার সংখ্যা ১৬ থেকে বেড়ে ১৯ হয়েছে।

6

এছাড়া জানুয়ারি মাসে নারী ও শিশুদের অপহরণ ও নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছিল ১৫টি। ফেব্রুয়ারিতে সংখ্যাটি বেড়ে ১৮তে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে, গণপিটুনির সংখ্যা কিছুটা কমলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এরকম ঘটনায় জানুয়ারিতে ১২ জন নিহত ও ১৮ জন আহত হয়েছিল। সেখানে ফেব্রুয়ারিতে গণপিটুনির ঘটনায় প্রাণ গেছে আট জনের, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৯ জন। আর মার্চের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ডাকাত সন্দেহে আরও দু’জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

বেশ কিছু ঘটনার পর অপরাধীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ হতে দেখা গেছে। বিক্ষোভকারীদের অনেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও তুলেছেন।

পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে মধ্যরাতে সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত করতে দেখা গেছে। সেখানে দ্রুতই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে তেমনটি লক্ষ্য করা যায়নি বলে জানাচ্ছেন মানবাধিকারকর্মীরা।

তারা বলছেন, উল্টো, একের পর এক অপরাধের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-আতঙ্ক ‘অনেকক্ষেত্রে আরও বেড়ে গেছে’।

সাধারণ মানুষ কী বলছে?

বিশ্লেষকেরা বলছেন, অপরাধ দমনের যে কোনো অভিযানের সফলতা বা ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভর করে পদক্ষেপটি সাধারণ মানুষের মনে কতটুকু স্বস্তি ফেরাতে পেরেছে বা পারছে, সেটার ওপর।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে এটা বোঝা যায় না। কারণ রিপোর্টেড ক্রাইম ও অ্যাকচুয়াল ক্রাইমের সংখ্যার মধ্যে সব সময় পার্থক্য থাকে।

তিনি বলেন, সেজন্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি আছে কি-না, বা তারা কতটুকু নিরাপদবোধ করছে, সেটা জানা জরুরি।

‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু এক মাস পর ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে।

7

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী রেজাউল করিম বলেন, দেশে একের পর এক ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ঘটছে এবং ফেসবুকে সেগুলোর যে ভিডিও দেখছি, তাতে আতঙ্কিত না হয়ে থাকা সম্ভব না।

উল্লেখ্য, গত কয়েক সপ্তাহে ছিনতাই ও ডাকাতির বেশ কিছু ভিডিও ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। এর মধ্যে ঢাকার বনশ্রী এলাকার একটি ভিডিওতে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণালংকার লুট করতে দেখা গেছে। ছিনতাইকারীরা সেদিন প্রায় দুইশ ভরির মতো স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিয়েছে বলে পুলিশের কাছে দাবি করেছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী।

আরও কয়েকটি ছিনতাইয়ের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে, যেখানে ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মালামাল লুট করতে দেখা যায়।

পাঁচই অগাস্টের পর ঢাকার যেসব এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা গেছে, সেগুলোর মধ্যে মোহাম্মদপুর একটি।

‘অপারেশন ডেভিল হান্টে’র দ্বিতীয় সপ্তাহে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ওই এলাকায় অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী, যেখানে গুলিতে দুইজন নিহতও হয়। নিহতরা ওই এলাকার ‘চিহ্নিত সন্ত্রাসী’ ছিল বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। আটক করা হয় আরও অন্তত পাঁচজনকে।

9

মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা তাইজুল ইসলাম বলেন, ওই ঘটনার পর চুরি-ছিনতাই কিছুটা কমেছে বলেই মনে হচ্ছে। তারপরও মানুষের মনে আতঙ্ক। বিশেষ করে ঈদের আগে পরিস্থিতি কেমন হবে, সেটা নিয়ে সবাই চিন্তিত।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, গত ছয় মাসে বাংলাদেশে ছিনতাই, ডাকাতি ও চুরির ঘটনায় অন্তত সাড়ে ১১৪৫টি মামলা হয়েছে, যার সংখ্যা একবছর আগে ছিল ৭৬৩টি।

এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় ঢাকাসহ অনেক এলাকায় রাতে দলবেধে পাহারা দিতে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের।

ঢাকার খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, চুরি-ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় আমরা মূলত এলাকার সেফটির জন্য এই টহল টিম বানিয়েছি।

এছাড়া নিরাপত্তা শঙ্কা থেকে অনেকে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্লোজড-সার্কিট, তথা সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করছেন। সেই সঙ্গে, আত্মরক্ষায় কেউ কেউ স্টিল, রড ও কাঠের লাঠি, এমনকি টেজার গানও কিনছেন বলে জানা যাচ্ছে।

যদিও ব্যক্তিপর্যায়ে টেজার গানের বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ে কারো কারো মধ্যে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশে এ ধরনের আত্মরক্ষা সরঞ্জামের বিক্রি নিষিদ্ধ কি-না, সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি পুলিশ কর্মকর্তারা। ফলে এগুলোর বিক্রিও থেমে নেই।

ঢাকার একজন বিক্রেতা মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ইদানিং হুট করে এগুলোর বিক্রি বেড়ে গেছে। মূলত: সেল্ফ ডিফেন্সের জন্য বাংলাদেশের নারী-পুরুষ উভয়ই এগুলো কিনতেছে।

11

ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি কেমন?

ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি বোঝার জন্য বিভিন্ন জেলার অন্তত দুই ডজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। তাদের কণ্ঠেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বেশ উদ্বেগ ফুটে উঠেছে।

তেমনই একজন যশোরের ব্যবসায়ী নাজমুল হক। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তাকে প্রায়ই ঢাকায় আসতে হয়। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি রুটে বাস ডাকাতির ঘটনার পর তিনি রাতের বাসে চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ব্যবসার কাজে ঢাকা যাই। কাছে টাকা-পয়সা থাকে। সেজন্যই রিস্ক না নিয়ে রাতে ট্রাভেল করা বন্ধ রাখছি আপাতত।

অন্যদিকে, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে চরমপন্থীদের তৎপরতা বৃদ্ধির ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে অস্থিরতা ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

এর মধ্যে ঝিনাইদহে সম্প্রতি তিনজনকে হত্যা করে তার দায় স্বীকার করে স্থানীয় একটি চরমপন্থী গোষ্ঠীর নামে বার্তা পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে। আর কুষ্টিয়ায় প্রায়ই প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া, ডাকাতি, খুন ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে গভীর রাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীরে অন্তত তিনটি ডাকাতি ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে বলে জানান তারা।

এছাড়া গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে একদল অস্ত্রধারী বালুর ঘাটে হামলা চালিয়ে ক্যাশ কাউন্টারের দুই লাখ টাকা লুট করে নেয়। ওই ঘটনায় বাধা দিতে গিয়ে স্থানীয় একজন গুলিতে আহতও হন।

স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী বলেন, আমরা গ্রামের মানুষ অনেক আতঙ্কিত। দেখা যাচ্ছে, গ্রামের বাজার ঘাট সন্ধ্যার পরেই বন্ধের একটা আভাস দিচ্ছে। এ জিনিসটা আসলে ভালো দিক নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যবসায়ী এটাও জানিয়েছেন যে, এসব অপরাধের বিরুদ্ধে পুলিশের কার্যকর কোনো ভূমিকা তারা দেখছেন না। ফলে এসব ঘটনায় পুলিশের কাছে কেউ অভিযোগ বা মামলা করছেন না।

তবে ফেব্রুয়ারিতে যৌথ অভিযান শুরু হওয়ার পর রাজশাহী ও রংপুর জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।

রাজশাহীর স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার আলী বলেন, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে প্রায়ই চুরি-ডাকাতির যে খবর শোনা যাচ্ছিল, এখন সেটা অনেকটাই কমে এসেছে।

12

অভিযান ঘিরে প্রশ্ন

গত আটই ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া অপারেশন ডেভিল হান্টে গ্রেফতারের সংখ্যা ইতোমধ্যে ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই অভিযানে পেশাদার অপরাধীরা সেভাবে ধরা পড়েনি বলে দাবি করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাইদুর রহমান বলেন, পেশাদার ছিনতাইকারী, পেশাদার ডাকাত, থানায় এরকম লিস্ট থাকে না? তারা এই অভিযানে এখন পর্যন্ত খুব একটা ধরা পড়েনি ।

তাহলে কারা গ্রেফতার হচ্ছেন?

সাইদুর রহমান বলেন, মোস্টলি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গ্রেফতার হয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে আমরা সেটাই দেখতে পাচ্ছি।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পক্ষ থেকেও একই দাবি করা হয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন জেড আই খান পান্না বলেন, যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং যারা বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে, তাদেরকেই এই অভিযানে গ্রেফতার করা হচ্ছে।

10

অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরুর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল যে জেলায়, সেই গাজীপুরে এখন পর্যন্ত ছয়শ’র বেশি মানুষ গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকেই সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে। এমন অবস্থায় অভিযানটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, এই অভিযানের মাধ্যমে ছিনতাই, ডাকাতি কমে আসবে বা মব জাস্টিস বন্ধ হবে বলে সাধারণ মানুষ আশা করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে এই অভিযানের লক্ষ্য হয়তো ভিন্নমতের উপর চড়াও হওয়া, এরকমই একটি বিষয় কিন্তু মানুষের মধ্যে আলোচনা চলছে।

তিনি আরও বলেন, আবার এটাও ঠিক যে, অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অনেকক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের যোগসাজস বা সমর্থন থাকে। সেক্ষেত্রে তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি প্রকৃত অপরাধীদেরও আইনের আওতায় আনতে পারলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

8
অর্ন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া

সরকার কী বলছে?

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সেভাবে উন্নতি হয়নি’ বলা হলেও ভিন্ন কথা বলছে সরকার। ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করার পর দেশে অপরাধ কমেছে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

তবে অর্ন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অবশ্য স্বীকার করছেন যে, পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলায়নি। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত কিছু কিছু জায়গায় উন্নতি হয়েছে, কিছু কিছু জায়গায় অবনতি হয়েছে।

ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে? প্রশ্ন ছিল উপদেষ্টার কাছে। আসিফ মাহমুদ বলেন, হত্যার মতো বড় ধরনের অপরাধ কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বেড়েছে অবশ্য।

অপরাধের ঘটনা যতটা ঘটছে, তারচেয়েও বেশি ‘প্রোপাগান্ডা’ চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অর্ন্তবর্তী সরকারের এই উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আসলে কনসার্নটা তৈরি হয়েছে কয়েকটা ঘটনা টানা ঘটলো এবং সেগুলোর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় যাওয়াতে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। তবে যতটুকু না ঘটনা ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি প্রোপাগান্ডা করা হয়েছে।

গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগিরাই এ ধরনের ‘প্রোপাগান্ডা’ চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

উপদেষ্টা বলেন, বাট আমি মনে করি, সরকার এ অবস্থার ওপর দ্রুতই নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছে।

যৌথ অভিযানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, বেআইনিভাবে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।

তিনি বলেন, যার নামে মামলা আছে, তাকে তো অবশ্যই ধরতে হবে। এ নিয়ে অভিযোগ করার কিছু নেই।

আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিবই মন্তব্যও করেন যে, ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগ এখন দেশকে অস্থিতিশীল করার ‘ষড়যন্ত্র’ করছে।

উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, তারা যে ষড়যন্ত্র করছে, এটা তো স্পষ্ট। তারা ডেভিল অ্যাক্টিভিজম করছে বলেই তো ডেভিল হান্টের প্রয়োজন পড়ল।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টাও বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, একটা পলাতক দল দেশ ছেড়ে চলে গেছে বা তাদের নেতৃত্ব চলে গেছে। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এটাকে (দেশটাকে) আনসেটেল (অস্থিতিশীল) করার জন্য ।

তাহলে কি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ধরতেই বিশেষ অভিযান— এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, না। এটা অভারঅল। অভারঅল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম করছে, জনজীবনে নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করছে, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই এই অভিযান।

কিন্তু অভিযানের পরও সবক্ষেত্রে অপরাধ আশানুরূপভাবে কমানো গেলো না কেন— এর জবাবে তিনি বলেন, জুলাই-অগাস্টের ঘটনায় পুলিশ বাহিনী যেভাবে একটা মোরাল অবলিগেশনের মধ্যে পড়ে গেছে, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে সময় লাগবে। এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে সম্পূর্ণ একটা আইডিয়াল সিচ্যুয়েশন পাবো, এটা কখনোই সম্ভব না।

আসিফ মাহমুদ বলেন, তবে যতদূর সম্ভব কন্ট্রোলে রাখা, জনগণের জীবনযাত্রা যাতে বিপর্যস্ত না হয়, সরকার সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

9

অভিযান কি শেষ?

শুরুর পর এক মাস না যেতেই ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শেষ হতে চলেছে কি-না, সেটি নিয়ে এক ধরনের আলোচনা দেখা যাচ্ছে।

অভিযান শেষ বলে স্থানীয় কিছু গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। কোনো কোনো খবরে এটাও দাবি করা হয়েছে যে, অভিযান চলমান থাকলেও সেটির নাম বদলে যাচ্ছে।

যদিও অভিযান শেষ বা নাম পরিবর্তনের বিষয়ে সরকারের ভেতরে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন অর্ন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, এ ধরনের কিছু সম্পর্কে আমি অবগত নই। উপদেষ্টা পরিষদেও এ নিয়ে কোনো আলোচনা ওঠেনি।

বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও জানান, এখনই অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করার মতো ‘কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি’। বরং ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’কে আরও ‘ফোকাসড ওয়ে’ বা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমুখী করা হচ্ছে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনিও সাংবাদিকদের একই কথা জানিয়েছেন।

গত ২ মার্চ অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি বলেন, কোর কমিটিতে আমরা এই ধরনের (অভিযান সমাপ্ত বা নাম পরিবর্তনের) কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। বরং মোর ফোকাসড ওয়েতে (অভিযানটি পরিচালনা) করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

এক্ষেত্রে রোজা চলাকালে ঢাকাসহ সারাদেশে যাতে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধ কীভাবে একেবারে কমিয়ে এনে জনমনে স্বস্তি ফেরানো যায়, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে অভিযানটি আরও কতদিন চলতে পারে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি। সূত্র: বিবিসি বাংলা

/এএস