images

জাতীয়

কক্সবাজার সৈকতে অবাধে বিক্রি হচ্ছে মাদক, অস্বস্তিতে পর্যটকরা

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৩৮ পিএম

images
  • স্থানীয়রাই বেশি জড়িত
  • রোহিঙ্গারাও আছেন এই তালিকায়
  • রাত হলেই শুরু হয় প্রকাশে বিক্রি 
  • ইয়াবাকে স্থানীয় ভাষায় কালাই বলেন তারা

কক্সবাজার এক সময় পর্যটনের নগরী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু সেই সুনামে ভাটা পড়েছে। এখন তা বিলীন হতে চলেছে মাদকের প্রভাবে। কক্সবাজার টেকনাফের সীমান্ত গলিয়ে ওপাশ থেকে বানের মতো ঢুকছে মাদক। এরপর তা কক্সবাজার হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার আগে তার অধিকাংশই বিক্রি হচ্ছে কক্সবাজার সৈকতে আসা পর্যটকদের টার্গেট করে। আর এসব মাদকের বিক্রেতা অধিকাংশই রোহিঙ্গা ও স্থানীয় লোকজন।

সম্প্রতি কক্সবাজার শহর ঘুরে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

গত ২৭ জানুয়ারি কক্সবাজার সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে কথা হচ্ছিলো কুমিল্লা থেকে বেড়াতে যাওয়া ইব্রাহিম সরকারের সঙ্গে। তিনি জানান, চলতি বছর ১০ বারের বেশি কক্সবাজার বেড়াতে এসেছেন। প্রতিবারই তার চোখে ধরা পড়েছে সৈকতে মাদক বিক্রির চিত্র।

তার কথায় কিছুটা সন্দেহ হলে সরেজমিন সৈকতে সন্ধ্যার পর থেকে প্রায় কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করে এই প্রতিবেদক। তাতে দেখা গেছে, উঠতি কিছু যুবক বার্মিজ মার্কেট ও সৈকতে ঘুরতে আসা পর্যটকদের টার্গেট করে করে ইয়াবা বিক্রি করছে। এই মাদককে তারা কালাই বলে থাকে।

সৈকতের রাস্তায় প্রায় ৭ বছরের বেশি সময় ধরে রিকশা চালান আলিম শেখ। তার মতে, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে এই কালাইয়ের হাট বসে। উঠতি যুবকরাই এই কালাইয়ের টার্গেট। বিক্রি হয় প্রতি পিস ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। বিভিন্ন জেলা থেকে আগত পর্যটকরা এসব কালাই কিনে হোটেল নিয়ে যান পরে রাতভর নেশায় বুথ হয়ে কাটে।

শুধু আলিম শেখই নয়, একই কথা জানালেন একটি অভিজাত পাঁচ তারকা হোটেলের একজন নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্বে থাকা আনসার আলীও (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, স্যারদের (হোটেলে আগত পর্যটকদের যে নামে ডাকে তারা) ব্যাগ তল্লাশি করি। স্ক্যানার মেশিনে দেওয়ার পর শব্দ হলেও বোঝা কঠিন। এজন্য আমরা কালাই (ইয়াবা) কিছু দেখা মাত্র ব্যাগটা আটকে দেই। পরে বেশির ভাগ সময়ই হোটেল মালিকদের অনুরোধে আবার দিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ ডাকলে আবার ঝামেলা হবে, তখন তো হোটেল ভাড়াও পাওয়া যাবে না। উল্টো মালিকের বদনাম হবে। এসব ভেবে আমরা কারও ব্যাগে এসব দেখলেও একটু সাবধান করে ছেড়ে দেই।

এই নিরাপত্তাকর্মী জানান, সৈকতে রাত যত গভীর হয় তত মাদক বিক্রির পরিবেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। এসব মাদক কিনে থাকে উঠতি তরুণ ও তরুণীরা। বিশেষ করে ঢাকায় থেকে যারা সেখানে বেড়াতে যান।

coxs1

আরও একটি অভিজাত হোটেলের কয়েকজন কর্মী জানিয়েছেন, কলাতলী ও সুগন্ধা বিচে সন্ধ্যার পর থেকে মাদক বিক্রি শুরু হয়। সৈকতে কোনো আলোরে ব্যবস্থা নেই। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মাদক বিক্রেতারা অবাধে মাদক বিক্রি করে। তবে মাঝে মাঝে পুলিশ অভিযান চালায়। সেটাও খুব কম। তবে তার আগেই খবর পেয়ে সাবধান হয়ে যান বিক্রেতারা। ফলে যে লাউ সেই কদু।

সৈকতে আসা একাধিক পর্যটক জানান, তারাও সৈকতে মাদক বিক্রির দৃশ্য দেখেছেন। তবে ভয়ে কাউকে কিছু বলেননি। তাদের ধারণা, পুলিশকে বললে কোনো লাভ হয় না। উল্টো সাক্ষী দেওয়া, মামলায় হাজিরা নানা জটিলতায় তারা না জড়াতে বিষয়টি প্রশাসনের কারও কাছে ফাঁস করেন না। আবার কেউ পুলিশকে খবর দিলে তার নাম ঠিকানা তারা লিখে রেখে দেন। বিষয়টি অনেকের কাছে ঝামেলার মনে হয়। এ কারণে তারা দেখেও না দেখার ভান করেন।

পর্যটকরা আরও জানান, এই মাদক বিক্রিতে স্থানীয়রাই বেশি জড়িত। কারণ, তাদের মুখের ভাষা কক্সবাজার জেলার মানুষের মতো। ফলে এই মাদক বন্ধে স্থানীয় মাদক বিক্রেতাদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের আগে ধরতে হবে বলেও তারা অভিমত দেন।

স্থানীয়রা বলছেন, কক্সবাজার এখন মাদকের শহরে পরিণত হয়েছে। সৈকতে গেলেই মিলছে মাদক। বিষয়টি প্রশাসনের সকলে জানলেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।

তাদের অভিযোগ, এসব মাদক আসছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে। তারাই মূলত কক্সবাজারের পরিবেশ ভারি করে তুলছে। ক্যাম্প থেকে বিকেলে রওনা হয়ে তারা সন্ধ্যায় ঢুকছে কক্সবাজার সৈকতে। রাতভর তারা মাদক বিক্রি করে ক্যাম্পে গিয়ে ঘুমাচ্ছে। প্রশাসনের কিছু লোকজনও এসব করছে বলেও অভিযোগ স্থানীয়দের।

স্থানীয়রা মনে করছেন, প্রশাসনের কঠোর নজরদারী ও পদক্ষেপই পারে এই মাদক বন্ধ করতে।

coxs2

কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি হেলাল উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, মাদক এই নগরীকে শান্তিপ্রিয় ও সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য বড় অন্তরায়। এটা অনেকাংশে ঠিক। কিন্তু এই মাদক বন্ধের জন্য সবচেয়ে বড় দরকার স্থানীয় লোকজনের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি। যারা বিক্রি করছে, গ্রহণ করছে তাদের শনাক্ত করা। প্রশাসনের লোকজন বাহির থেকে এসে জানবে না এটার জন্য কী করতে হবে। এজন্য স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে সঠিক কর্মকৌশল নির্ধারণ করে মাদক কিন্তু বন্ধ করা যায়।

হেলাল উদ্দিন বলেন, মিয়ানমার সরকার মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি মানার কথা বলেছে। তাদের পাশাপাশি আমাদের দেশের বর্ডার গার্ড ও প্রশাসনের সদস্যরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তরিকভাবে যদি মাদক প্রতিরোধে কাজ করে তবে এটি বন্ধ করা সম্ভব।

কক্সবাজার মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সিরাজুল মোস্তফা ঢাকা মেইলকে বলেন, কক্সবাজারে ইয়াবা বেড়েছে। বেড়েছে ব্যবসায়ীর সংখ্যাও। কক্সবাজার শহর ছাড়াও এই যে আর ৩০ শতাংশ মানুষ এখন মাদক ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। আমরা প্রতিনিয়ত মাদক কারবারি এবং মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করছি। কক্সবাজারে এখন ইয়াবা ক্রিস্টাল মেথ বেশি প্রভাব রয়েছে। অন্য মাদক তেমন নেই বললেই চলে। কক্সবাজারের উখিয়া মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে এসব মাদক বাংলাদেশে ঢুকছে। আমরা প্রতিনিয়ত মাদককারবারিদের ধরছি। কিন্তু তারা জামিনে বের হয়ে আবারও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেননি।

এমআইকে/এমএইচটি