images

জাতীয়

জাতিসংঘের রিপোর্ট মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে সহায়ক হতে পারে

ঢাকা মেইল ডেস্ক

১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৫২ পিএম

images

বাংলাদেশে গত জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের সময় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) এই প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

এছা়ড়া যারা দেশের বাইরে পলাতক আছেন তাদের ফিরিয়ে আনার জন্যও এই প্রতিবেদন সহায়ক হবে বলে মনে করছেন তারা।

প্রতিবেদনে যা আছে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানের পর জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস জুলাই-আগস্টের ঘটনা নিয়ে তদন্ত করেছে। বুধবার সেই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে এক হাজার জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে এবং এসময় হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। এদের অধিকাংশই বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনীগুলোর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, তাদের ৪৪ জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।

বাংলাদেশের সাবেক সরকার, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংস সংগঠনগুলো গত বছরের ছাত্র-জনতার তুমুল বিক্ষোভের সময় পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

কীভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মকর্তারা একাধিক বড় আকারের অভিযানের নির্দেশনা দেন ও তদারকি করেন, যেখানে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের গুলি করে হত্যা করেছিল বা নির্বিচারে গ্রেফতার ও নির্যাতন করেছিল; তার প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ৷

যখন সাবেক সরকার দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছিল তখন সংঘটিত প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থক, পুলিশ এবং মিডিয়াকে লক্ষ করে করা অন্যান্য গুরুতর প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনাগুলোও নথিভুক্ত করেছে জাতিসংঘের তদন্তকারীরা।

হিন্দু, আহমাদিয়া মুসলিম এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর আদিবাসী জনগণের বিরুদ্ধেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। যদিও বিভিন্ন ধর্মীয় ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের সাথে সম্পর্কিত প্রায় ১০০ জন গ্রেফতার হয়েছে। তবে অনেক প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং এসব গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের পরেও অপরাধীরা এখনও দায়মুক্তি উপভোগ করছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

 

‘জাতিসংঘের রিপোর্ট সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ আছে’

পূর্ব তিমুরে জাতিসংঘের অধীনে গণহত্যার জন্য গঠিত আদালতের সাবেক বিচারক ড. শাহজাহান সাজু বলেন, এখানে এখন যে গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেই আদালতে জাতিসংঘের এই রিপোর্ট সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার করার সুযোগ আছে। এজন্য বাংলাদেশে জাতিসংঘ অফিসের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। সেই আবেদন তারা গ্রহণ করলে তাদের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে সাক্ষ্য দেবেন। তাদের কাছে ডকুমেন্ট আছে। আলামত আছে। সব কিছুই তখন বাংলাদেশের আদালতে উপস্থাপন করা যাবে৷

তিনি আরও বলেন, তারা যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে বাংলাদেশ সরকারের গণহত্যার বিচার অনেক সহজ হয়ে গেছে। যারা বড় বড় এই মামলায় আসামি তাদের অপরাধের কথা তো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ড. সাজু বলেন, আবার সরকার চাইলে এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসেও যেতে পারে। কিন্তু এখানে বিচারেও কোনো সমস্যা নাই। কারণ এটা মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, জতিসংঘ তো তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে এখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে। এখন সরকার জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন কীভাবে কাজে লাগাবে তা তাদের বিবেচনার ব্যাপার। সরকার এখন নিশ্চয়ই এটা বিশ্লেষণ করে দেখবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেবে।

তিনি আরও বলেন, সরকার যদি মনে করে তাহলে এই বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এখানে তো মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকার সেখানেও এই রিপোর্ট কাজে লাগতে পারে। পলাতক আসামিদের ফেরত আনার জন্য এই প্রতিবেদন সহায়তা করবে ৷

মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এর পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবদেনে এটা স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগ সরকার তার ক্ষমতা ধরে রাখতে এখানে গণহত্যা চালিয়েছে। বাংলাদেশে তার বিচার শুরু হয়েছে। কিছু গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু অনেকেই দেশের বাইরে পলাতক আছেন। আমার মনে হয় সরকার এই প্রতিবেদন কাজে লাগিয়ে পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারে। জাতিসংঘের সহায়তাও চাইতে পারে। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন শেখ হাসিনাসহ অন্যদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে সহায়তা করবে। সরকারের সেই চেষ্টা করা উচিত। জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনা নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, প্রতিবেদনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কথাও উঠে এসেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদী দলের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা মনে হয় সরকার ও বাংলাদেশের জনগণের আওয়ামী লীগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

‘জাতিসংঘের কাছে কেস টু কেস তদন্তের সহায়তা চাইতে পারে সরকার’

মানবাধিকার কর্মী এবং সরকারের গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়েছে যে সাবেক সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গণহত্যার দায় এড়াতে পারবেন না। সাবেক সরকার নিজ দেশের নাগরিকদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। তাই এটা নিঃসন্দেহে মানবতাবিরোধী অপরাধ। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এরইমধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই বিচার জাতিসংঘের প্রতিবেদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছে৷

তিনি আরও বলেন, প্রতিবেদনে জেনোসাইড শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। এই কারণেই হয়তো তারা অধিকতর তদন্তের কথা বলেছে। আমার মনে হয় জাতিসংঘের কাছে এখন কেস টু কেস তদন্তের সহায়তা চাইতে পারে সরকার। তাতে গণহত্যার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে৷

স্বাগত জানিয়েছে সরকার 

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের রিপোর্টকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি পুলিশ, প্রসিকিউটর এবং বিচারকসহ বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সকলকে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি অন্তর্বর্তী সরকারে কর্মরত সকল ব্যক্তি এবং কোটি কোটি নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশকে এমন একটি দেশে রূপান্তরিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যেখানে সকল মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারবে। সূত্র: ডয়সে ভেলে

এফএ