মাহফুজ উল্লাহ হিমু, মোস্তফা ইমরুল কায়েস
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:১০ পিএম
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও ভারতে পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ীটি এখন প্রায় ধ্বংসস্তুপ। বেশিরভাগ অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফলে ভাঙা অংশগুলো থেকে লোহা-লক্কর সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে ভাসমান মানুষজন।
কেউ কেউ এখনো জানালায় লেগে থাকা কাঠ কাটতে ব্যস্ত, কেউ দরজার বিম ও ভবনটিতে ওঠার জন্য তৈরি করা লিফটের লোহার অংশগুলো খুলে নিয়ে যাচ্ছেন। যারা এসব করছেন তাদের সবার হাতে হাতুড়ি, হ্যাক্সো ব্লেড প্রভৃতি দেখা যাচ্ছে। সেই বাড়ির সামনে গেলেই কানে ভেসে আসছে ভবনের ভাঙা অংশগুলো থেকে রড কেটে ও ভেঙে বের করার বিভিন্ন শব্দ।
শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাড়িটির সামনে, পেছনে ও চারদিকে ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। সব মিলে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সেই বাড়িতে এখন হরিলুট চলছে।
হাজারীবাগ থেকে এসেছেন সেজু মিয়া। তিনি রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু লোক মুখে শুনেছেন হাসিনার বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভবনের কাছে গেলেই রড পাওয়া যাচ্ছে। কেটে বিক্রি করলে সারাদিনের আয় তার। এমন আশাতে সকালে এসেছেন তিনি। দুপুর পর্যন্ত মাত্র এক কেজির মতো পুরান রড পেয়েছেন। তার মতে, আরও আগে আসলে আরও পেতাম।
সেজু মিয়া বলেন, এই বাড়ি তো এখন ভাঙা। কোনো দাম নেই। যে যার মতো করে জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। তাহলে তার ভবনে লেগে থাকা রড কেটে নিয়ে যেতে সমস্যা কোথায়?
শেখ হাসিনার পৈতৃক বাড়ি বিক্ষুব্ধ জনতা ভাঙার পর এখন সেখানে এভাবেই ধসে পড়া ছাদ, বিম ও পিলারের রড কেটে নিচ্ছে ভাসমান মানুষ ও টোকাইরা।
গত বুধবার রাতে ভারতে পলাতক শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ওই রাতেই বিক্ষুব্ধ জনতা তার বাবার বাড়ির সামনে হাজির হয়। প্রথমে বাড়িটিতে আগুন দেওয়া হয় এবং পরে ভাঙা হয়।
সরেজমিনে প্রায় ১০০ জনের বেশি ভাসমান মানুষজন পাওয়া গেছে; যারা এই বাড়ির লোহা-লক্কর সব খুলে নিয়ে যাচ্ছেন। আর এ কাজ সহজে করার জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আনার পাশাপাশি তারা রিকশাও ভাড়া করে নিয়ে এসেছেন।
আলমাছ হোসেন তার ভাড়ায় চালিত রিকশা নিয়ে এসেছেন হাজারীবাগ থেকে। তিনি ভবনটির উত্তর দিকে তার রিকশায় দাঁড়িয়ে দেখছেন। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, আপনি কেনো এসেছেন। তিনি জানান, ভবনটি থেকে খুলে নেওয়া মালামাল বহন করা হবে। এজন্য তাকে এক ট্রিপ ২০০ টাকা দেবেন এক লোক। সেই শর্তে তিনি সেখানে এসেছেন।
অবশ্য তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন তার পেছনে আরও কয়েকটি রিকশা দেখা যাচ্ছিল। তার মধ্যে একটি ভবন থেকে খুলে নেওয়া বেশ কিছু রড রাখা ছিল। পাশেই আরেক দল মূল ভবনে থাকা লিফটের অংশগুলো খুলে নেওয়ার পর বাকি লোহার অংশগুলো খুলে নেওয়ার কাজ সারছেন। কেউ কেউ আবার বাড়ির নিচের তলায় থাকা অংশ খুলে নিচ্ছেন।
হাজারীবাগ থেকে এসেছেন আরেক যুবক নাজু। তিনি প্লাস্টিক ও রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা জিনিসপত্র কুড়িয়ে বিক্রি করেন। তার সাথে এসেছেন আরও দুই যুবক।
রায়েরবাজার থেকে এসেছেন সোহেল মিয়াসহ আরও কয়েকজন। তিনি জানান, দুপুরে এসেই মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে তারা ১০ কেজির মতো পুরোনো রড পিলার থেকে খুলতে পেরেছেন। তারা আরও চেষ্টা চালাচ্ছেন। সংগ্রহ শেষ করে সেগুলো তারা ভাঙ্গারীর দোকানে ২৫ কেজি টাকা দরে বিক্রি করবেন।
ফয়জু নামের এক যুবক জানান, ঢাকায় তার কোনো থাকার জায়গা নেই। তিনি রাস্তাঘাটে থাকেন। এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে মোহাম্মদপুর থেকে এসেছেন। ভাঙা অংশের একটা বাছাই করে তাতে হাতুড়ি চালাচ্ছেন।
শুধু যুবকরা নয়, নারীরাও এসেছেন এই কাজ করতে। আবার রড ও বিভিন্ন দামি তার কেটে খুলে নিয়ে যাওয়ার সময় কারও কারও সাথে ঝগড়াও বাঁধছে। ঠিক সাড়ে ১২টার দিকে বাড়িটির পূর্ব গেট দিয়ে একটি রিকশাকে ঘিরে কিছু মানুষের জটলা ও বাকবিতণ্ডা লক্ষ করা যায়। পরে জানা গেল, তারা টোকাই। এক দল ধ্বংসস্তুপ থেকে মোটা দামি ইলেকট্রিক তার কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। এ দৃশ্য দেখে ফেলে আরেক গ্রুপ ছুটে আসে তাদের বাধা দিতে। এসময় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তিও হয়। শুধু কি তাই, ভবনটির ভাঙা অংশের ওপরে বসে রড কাটতে গিয়ে এক ব্যক্তি পড়ে গিয়ে গুরুতর আহতও হয়েছেন। পরে তাকে উদ্ধার করে লোকজন রিকশায় তুলে নিকটস্থ হাসপতালে নিয়ে যায়।
কদমতলী থেকে এসেছিলেন রাসেল আহমেদ। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, দেখেন আজ হাসিনার বাবার বাড়ি ভেঙে দিয়ে সেখান থেকে লোকজন রড খুলে নিয়ে যাচ্ছে। এটা কিন্তু তার বা তাদের জন্য বড় শিক্ষা। যদি তারা শিক্ষা নেয় তবে ভালো। নয়তো তাদের সমর্থকদের সামনে আরও করুণ পরিণতি হবে মনে হচ্ছে।
টোকাই ও ভাসমান মানুষজন রড খুলে নিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সেখানে থাকা লোকজন এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ বা কথা বলতে শোনা যায়নি। উল্টো তারা বলছেন, সব নিয়ে যান। কোনো জিনিস রাখা যাবে না। এখানে জুলাই-আগস্টে আহতদের জন্য ভবন তৈরি করা হবে।
এমআইকে/এমএইচ/এফএ