মোস্তফা ইমরুল কায়েস
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:১২ পিএম
রবিন মিয়া থাকেন দুবাইয়ে। চাচাতো ভাই তানজিমকে ফোনে কল করে জানান একজন দেশে ফিরবেন। তার কাছে তিনি কিছু স্বর্ণালঙ্কার ও কয়েকটি মোবাইল ফোন পাঠিয়েছেন। তানজিম যেন সেগুলো বিমানবন্দরে ওই ব্যক্তির কাছ থেকে বুঝে নেন। সেই মোতাবেক হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে চলে যান তানজিম। পরে সেই ব্যক্তিকে পেয়ে সব কিছু বুঝেও নেন। এরপর তানজিম ও শাসমু নামে তার এক বন্ধু মিলে রাইদা পরিবহনের একটি বাসে চড়ে দক্ষিণ বনশ্রীর বাসায় ফিরছিলেন। পথে তাদের বহনকারী বাসটি থামিয়ে র্যাব পরিচয়ে ছয় ব্যক্তি তাদের নামিয়ে নেয়। এরপর একটি সাদা একটি মাইক্রোবাসে তুলে প্রথমে তাদের চোখ বেঁধে ফেলা হয়। পরে ব্যাপক মারধর করে তাদের তুলে নেওয়া ব্যক্তিরা। এক পর্যায়ে তাদের পকেটে থাকা সাড়ে ২২ হাজার টাকা, ১০০ গ্রাম স্বর্ণালঙ্কার, তিনটি নতুন মোবাইল নিয়ে নেয় র্যাব পরিচয়ধারী ব্যক্তিরা। এরপর তাদের বনানী ফ্লাইওভারের ওপরে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায় সেই ছয় ব্যক্তি।
মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) ভোর সাড়ে ৫টা থেকে ৫টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে এই ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনার পর ভুক্তভোগীরা সেদিন সকালে বিমানবন্দর থানায় গেলে পুলিশ অভিযোগ না নিয়ে তাদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়। এতে হতাশ হয়ে তারা বাসায় ফেরত আসেন।
প্রবাসীর রবিনের চাচাতো ভাই ভুক্তভোগী তানজিম ঢাকা মেইলকে সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা তুলে ধরে বলেন, ‘আমার চাচাতো ভাই রবিনের পক্ষ থেকে পাঠানো জিনিসপত্রগুলো সেই ব্যক্তির কাছ থেকে আমরা বুঝে নিয়ে বিমানবন্দরের সামনের রাস্তায় আসি। এরপর পূর্ব দিকে মসজিদের পেছনে থাকা পুলিশ বক্সের সামনে রাইদা পরিবহনের একটি বাসে উঠি। বাসটি সেখান থেকে কাওলা যাওয়ার সড়কের মুখে থাকা পুলিশ বক্সের দিকে যাচ্ছিল। এ সময় পেছন দিক থেকে ছুটে আসে একটি হায়েজ মডেলের সাদা মাইক্রোবাস। সেটি বাসটির সামনে এসে দাঁড়ালে চালক বাস থামায়। তখন আমরা বাসের পেছনের দিকের সিটে বসা ছিলাম। আমরা দেখছিলাম কয়েকজন লোক উঠল। তাদের সবার গায়ে র্যাব লেখা জ্যাকেট। তারা উঠে আমাদের উদ্দেশ্য করে বলছিল- ‘এই তোরা চল। তোদের কাছে স্বর্ণ আছে!’ এরপর নামিয়ে সোজা মাইক্রোবাসে তুলে নেয় তারা। তার আগে আমার চোখ বেঁধে ফেলা হয়।’
এর পরের ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘মাইক্রোবাসটি চলন্ত অবস্থায় ছিল। আমরা বলছিলাম কেন আপনারা আমাদের তুললেন? তারা বারবার বলছিল- এই স্বর্ণ কোথায় রাখছিস বল। এরপর আমি মাইরের চোটে আমার পকেটে থাকা ১০০ গ্রামের স্বর্ণালঙ্কারগুলো বের করে দিই। এসময় তারা আমার পকেটে থাকা ১৯ হাজার টাকা ও তিনটি সামসাং এ থার্টি মডেলের ফোন কেড়ে নেয়। পরে আমাদের সঙ্গে থাকা ব্যবহৃত ফোনগুলো নিয়ে তারা সিম খুলে ফেলে। এক পর্যায়ে বনানী ফ্লাইওভারের ওপরে নামিয়ে দেয়। আমরা ওই সময় অন্ধকার থাকায় গাড়ির নম্বরও দেখতে পাইনি।’
তার সঙ্গে থাকা বন্ধু শামসু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার পকেটে থাকা সাড়ে তিন হাজার টাকাও তারা নিয়েছে। আমরা তাদের বারবার বলেছি আমাদের অপরাধ কী বলেন। কিন্তু তারা বারবার বলছিল স্বর্ণ বের করে দে। আমরা ধারণা করছি, তারা আমাদের বিমানবন্দর এলাকা থেকেই ফলো করেছে।’
তানজিম ও শামসু জানান, তারা বাসে ওঠার দুই তিন মিনিটের মধ্যে মাইক্রোবাসটি তাদের বহনকরী বাসটিকে থামায়। তাদের যখন তুলে নিয়ে যাচ্ছিল তখন বাসে থাকা সাত থেকে আটজন যাত্রী কোনো প্রতিবাদ করেনি। তারা হয়ত ভেবেছিল, আসলেই র্যাবের সদস্য হবে। কারণ সবার গায়ে র্যাব লেখা জ্যাকেট বা কটি ছিল।
তারা আরও জানিয়েছেন, এই ঘটনার পর দুই বন্ধ মিলে মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বিমানবন্দর থানায় যান এবং বিষয়টি দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তাকে খুলে বলেন। সেই কর্মকর্তা তাদের সব শুনে শুধু ডায়েরিতে নোট নেন এবং বিষয়টি তদন্ত করে অভিযোগ আকারে নেওয়া হবে বলে জানান। এই কথা শুনে তারা থানা থেকে বাসায় চলে যান।
ঘটনাস্থল নিয়ে পুলিশের ঠেলাঠেলি!
তাদের অভিযোগ, তারা থানায় গেলেও পুলিশ তাদের কোনো অভিযোগ নেয়নি। উল্টো তাদের কেন টার্গেট করা হলো বা এ জাতীয় নানা প্রশ্ন করেছে পুলিশ। ভুক্তভোগী হয়ে থানায় গিয়ে পুলিশের এমন আচরণে অবাক হয়েছেন প্রবাসীর এই দুই স্বজন।
আরও পড়ুন
বিমানবন্দরে র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতি, চারজন আটক
র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে পাঠানো হয় ভারতে, ১৬ মাস পর বাড়ি ফিরল যুবক
তারা আরও অভিযোগ করেছেন, সেই কর্মকর্তা তাদের বিষয়টি শুনে প্রথমে এই ঘটনার অবস্থান বিমানবন্দর নাকি খিলক্ষেত থানা এলাকায় সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। পরে বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু গেল দুই দিনেও পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।
এ বিষয়ে বিমানবন্দর থানার ওসি (তদন্ত) রফিকুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এরকম ঘটনা তো প্রায়ই ঘটে। দেখা যায়, যারা মাল রিসিভ করেছে তারাই আবার তাদের লোকজনকে দিয়ে এমন নাটক সাজায়। ফলে আমরা এমন ঘটনাও পেয়েছি। এছাড়াও তারা যেখানে এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন সেটি আমাদের এলাকা কি না সেটাও জানা প্রয়োজন। তবে যারা এমন অভিযোগ করেছেন তারা কোনো লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কি না ও কার কাছে থানায় এসেছিলেন জেনে জানাতে পারব।’
র্যাব যা বলছে
এ বিষয়ে র্যাব সদর দফতরের মিডিয়া বিভাগের সহকারী পরিচালক এএসপি মুত্তাজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, এমন অভিযোগ থাকলে র্যাব-১ এ গেলে তারা বিষয়টি শুনে ব্যবস্থা নেবে।
পরে র্যাব-১ এর এএসপি মাহফুজকে কল করা হলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা তাদের কাছে বিষয়টি শুনতে চাই। এজন্য তারা সরাসরি এলে খুব ভালো হয়। কারণ এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তারা বিষয়টি জানালে সেই অনুযায়ী চক্রটিকে ধরতে আমাদের সহজ হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গেল কয়েক বছর ধরে বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে আসা প্রবাসী ও তাদের স্বজনদের টার্গেট করে একটি চক্র। ইতোমধ্যে কয়েকটি চক্রকে গ্রেফতারও করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এমআইকে/জেবি