বোরহান উদ্দিন
০৬ জুন ২০২২, ০৩:৩০ এএম
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিলো ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে৷ ওই বছরের ৩ রা জুনের ওই ট্রাজেডিতে প্রাণ হারান ১১৭ জন। ঠিক এর একযুগ পর ৪ জুন রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন আবারও নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। দু’টি অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপকতার জন্য অভিযোগের তীর কেমিক্যাল ব্যবসার দিকে। যে কারণে শত চেষ্টায়ও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনী সদস্যদের।
এদিকে শনিবার রাতে লাগা আগুন রোববার রাতেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এ সময়ের মধ্যে প্রাণ গেছে ৪৫ জনের। যার মধ্যে ৯ ফায়ার সার্ভিসের সদস্যও আছেন।
কর্মকর্তারা বলছেন, এ ডিপোটি প্রায় ২৬ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। ধারণা করা হচ্ছে সেখানে কয়েক হাজার কন্টেইনার ছিলো। এসব কন্টেইনারে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ছাড়াও আরো কিছু রাসায়নিক ছিলো বলে ধারণা করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।।
এদিকে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ রাখার কোনো অনুমতি নেই। সেখানে দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণ বা মজুদের কোনো নিয়ম না মানার কারণেই হয়ত ভয়ানক এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তারা ধারণা করছেন।
যদিও ডিপো কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের সব ধরনের অনুমোদন রয়েছে।
এমন বাস্তবতায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি সময় ধরে আগুন জ্বলতে থাকার কারণ হিসেবে প্রথমে আগুনের ভয়াবহতা বুঝতে না পারা, কেমিক্যালের কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে যাওয়া, ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের জোনকেন্দ্রিক সীমানা বুঝতে না পারাকে দুষছেন।
বিশেষজ্ঞরা এতবড় এক কন্টেইনার ডিপোর সার্বিক নিরাপত্তা, এখানে কোন ধরণের কেমিক্যাল রাখা আছে সেসব বিষয়ে সঠিক তথ্য জেনে তদারকি না থাকার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকেও দায় দিচ্ছেন।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) শাকিল নেওয়াজ ঢাকা মেইলকে বলেন, ১১ বছর আগে কার্যক্রম শুরু করা এ জায়গাটির সার্বিক নিরাপত্তা কেমন সেটা সবার আগে দেখা উচিত ছিলো। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে এখানে মজুদ থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কথা তারা জানেন না। তাহলে কীভাবে এলো এগুলো? এভাবে তো দায়সারা কথায় দায়িত্ব এড়ানো যায় না। তাদের অবহেলা থাকলে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে এবং কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এতগুলো মানুষের নিহত হওয়ার মতো ঘটনাকে তুচ্ছজ্ঞান করা ঠিক হবে না।
অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস বলছে, মালিক পক্ষ থেকে কোনো ধরণের সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে ভয়াবহতা বেড়েছে। প্রথমে বিএম কনটেইনারে লাগা আগুনকে সাধারণ আগুন বলে মনে করা হয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা কাজ শুরুর আগ পর্যন্ত জানতে পারেননি ভেতরে কী আছে। সেখানে দাহ্য কেমিক্যাল ও রফতানির জন্য গার্মেন্টসের তৈরি পোশাকও ছিল বলে জানা গেছে। আগুন নেভানোর সময় কর্তৃপক্ষের কাউকেও পাওয়া যায়নি। এসব কারণে কর্মীরা বেশি ঝুঁকিতে পড়েছেন এবং অসংখ্য লাশের মিছিল আমরা দেখেছি।
ফায়ার সার্ভিসের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, আগুন লাগার সময় কর্তৃপক্ষ ভেতরে কী ধরনের বস্তু রয়েছে তা জানালে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে পারলে বড় ধরনের বিপদ হয়তো এড়ানো যেত।
অন্যদিকে বিএম কনটেইনার ডিপোর পরিচালক মো. মজিবুর রহমান ভয়াবহতার দায় চাপালেন ফায়ার সার্ভিসের ওপর।
গণমাধ্যমকে মজিবুর রহমান বলেছেন, 'হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ক্যামিক্যাল কখনও নিজে থেকে জ্বলে না। অতিরিক্ত হিটে আগুন ধরে ও বিস্ফোরিত হয়। ফায়ার সার্ভিস যদি সঠিক নিয়মে কাজ করত তাহলে এখানে কিছুই হতো না।'
যদিও তার এমন বক্তব্য সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন)-এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রেজাউল করিম।
তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত সদস্য রয়েছে ফায়ার সার্ভিসে। কেমিক্যালের আগুন নিভানোর বিষয়ে প্রশিক্ষিত সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে এবং তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করে যাচ্ছে। যেকোনও ধরনের আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু আগুন লাগার সময় ভেতরে কোন ধরণের জিনিস আছে তা জানালে কাজ করা অনেক সহজ হতো।
এর আগে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকও অভিযোগ করেছেন, মালিক পক্ষের কাউকে তারা পাননি। এখানকার কেমিক্যাল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কেউ সঠিক তথ্য দিলে সে অনুযায়ী তারা কাজ করলে এত ক্ষতি হতো না।
যদিও হতাহত নিয়ে ফায়ার সার্ভির্সের বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত প্রকাশ করেছেন সাবেক পরিচালক পরিচালক শাকিল নেওয়াজ।
তার ভাষ্য, এমন দুর্ঘটনায় সবার আগে জরুরি নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করে কাজ করা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলের ১০০ মিটারকে বলা হয় হট জোন। ৩০০ মিটারকে বলা হয় ওয়ার্ম জোন। তারপরের অংশ হচ্ছে কুল জোন। হট জোনে একমাত্র কেমিক্যাল এক্সপার্ট লোক ঢুকবে। সীতাকুণ্ডে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে থাকতে পারে।
জানা গেছে, প্রথম দিকে ফায়ার সার্ভিসের যেসব কর্মী উদ্ধারে এসে বেশি এগিয়ে গেছেন তারাই বেশি হতাহত হয়েছেন। যদিও দুপুর নাগাদ বিশেষায়িত হেজবোর্ড টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছায়। যারা কেমিক্যালের মধ্যে ঢুকে অগ্নিনির্বাপণের কাজ করতে সক্ষম।
বিদেশে প্রশিক্ষণ নেয়া এ টিমের সদস্যরা যতক্ষণে সীতাকুণ্ড পৌঁছান ততক্ষণে ৫ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের পর ডিপোতে কিছু সময় পরপর বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এর মাধ্যমে এটা বোঝা যায় যে কত ভয়াবহ ছিলো সীতাকুণ্ডের ঘটনা। বিশেষ করে প্লাস্টিকের যে সব ড্রামে কেমিক্যাল রাখা ছিলো সেগুলো তাপে গলে একাকার হয়ে গেছে।
অগ্নিকাণ্ড নিয়ে কাজ করা ফায়ার সার্ভিসের সাবেক এ কর্মকর্তার ধারণা বিএম কনটেইনার ডিপোর ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ছিলো।
তিনি বলেন, 'কেমিক্যাল সব সময় আলাদা জায়গায় রাখতে হয়। একটি কনটেইনার থেকে আরেকটি কনটেইনার নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হয়। যাতে একটি বিস্ফোরণ বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কিন্তু এখানে তেমনটা ছিলো বলে মনে হয় না।'
এদিকে রোববার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মো. শাহজাহান জানান, আগুন লাগার পর কন্টেইনারে থাকা রাসায়নিক ভর্তি জার ফেটে যায়। এতে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বের হয়ে কনটেইনারের সংস্পর্শে আসে। অক্সিজেন নির্গত হয়ে আগুনের সংস্পর্শে এসে জ্বলতে থাকে। এতে কন্টেইনারের ভেতরে তাপমাত্রা বেড়ে বিস্ফোরণ ঘটে।
অন্যদিকে সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদারকি করা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা লে. কর্নেল রেজাউল করিম বলেন, 'আগুন নেভানোর সময় বিস্ফোরণে প্রাথমিক যে দলটি সেখানে কাজ করছিল তাদের কয়েকজন নিহত হন। কিন্তু যদি জানা যেত এখানে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রাসায়নিক পদার্থ আছে তাহলে আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারতাম। রাসায়নিক বিশেষজ্ঞরা তাদের সরঞ্জাম নিয়ে আগেই সেখানে যেতে পারত।'
এদিকে এমন দুর্ঘটনা ঘটার পর তদন্ত কমিটি করলেও তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না বলে অভিযোগ আছে।
তবে চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্ত শেষে এ ঘটনায় কারো গাফলতি থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিইউ/এমইউ