মোস্তফা ইমরুল কায়েস
২২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৫ পিএম
আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজধানীর পল্লবী এলাকা। রক্ত ঝরিয়ে মহড়া দিচ্ছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ। যা সন্ত্রাসী ব্লেড বাবু খুনের মধ্যদিয়ে আরও অনেকটাই স্পষ্ট হলো। ফলে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সেই এলাকার মানুষজন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। যদিও এই আলোচিত ঘটনায় এখনো কেউ আটক বা গ্রেফতার হয়নি।
তবে পুলিশের দাবি, খুব শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনবেন তারা।
গত ৫ আগস্টের পর রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বাড়লেও পল্লবী ছিল অনেকটা শান্ত। কিন্তু অক্টোবর থেকে উত্তপ্ত হতে শুরু করে এই এলাকা। গেল অক্টোবরে পল্লবীর ১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সিরামিক রোডের ময়লা পট্টিতে চাঁদা না পেয়ে লাবলু নামে এক নাইটগার্ডকে গুলি করা হয়। পরে এ ঘটনায় বাবলুর ভাই বাদী হয়ে পল্লবী থানায় ব্লেড বাবু, পকা, ডাকাত সামি, নাইক্কা অনিক নামে চারজনের নামে একটি মামলা করেন।
সেই অভিযোগে বলা হয়েছে, পল্লবীর ১২ নম্বর সিরামিক রোডে ৪০টি বাস (রাজধানী পরিবহন, মিরপুর সুপার লিংক, স্বাধীন পরিবহন) প্রতিদিন রাতে পার্কিং করে রাখা হয়। রাস্তায় পার্কিং বাবদ প্রতি বাস থেকে ১০০/১৫০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এতে প্রতিদিন ৫/৬ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। ওই টাকার কিছু অংশ নাইটগার্ড লাবলু দৈনিক বেতন হিসেবে নেন আর অবশিষ্ট টাকা স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা ভাগ করে নেন। গত কয়েকদিন ধরে নাইটগার্ড লাভলুর কাছে বাস পার্কিংয়ের উত্তোলিত টাকার ভাগ চান অভিযুক্তরা। লাবলু টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে গুলি চালালে তার বাম পায়ে গুলি লাগে। সেই সময় পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলাম জানান, ঘটনাটিতে অভিযোগ পড়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে।
এর আগে ২০২১ সালের ১৬ মে পল্লবীর ১২ নম্বর ডি-ব্লকে ৩১ নম্বর রোডের ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে একটি গ্যারেজে স্থানীয় জয়নুদ্দিনের ছেলে শাহিন উদ্দিনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপির লোকজন ছাড়াও উঠতি চাঁদাবাজরা নানাভাবে এলাকাবাসীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কেউ সড়কে, কেউ গলিতে, কেউ বিভিন্ন সরকারি জমির দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে আগে যেসব স্থানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা চাঁদা তুলতেন সেসব স্থানের দখল নিতেই এখন বিভিন্ন গ্রুপ সক্রিয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন বাসা বাড়ির মালিককেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। যারা বিগত সময়ে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তারা এখন রাতারাতি ভোল পাল্টিয়ে বিএনপি ও যুবদল হয়ে গেছেন। উল্টো তারা এখন বিভিন্ন ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগের দোসর তকমা দিয়ে মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন।
স্থানীয়রা জানান, গেল কয়েক মাস থেকে সেই এলাকায় ব্লেড বাবু ও মুসার মধ্যে চাঁদাবাজি এবং এলাকার আধিপত্য নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। সর্বশেষ আধিপত্য ধরে রাখতে মুসার লোকজন ব্লেড বাবুকে খুন করেন। তবে ব্লেড বাবুও কম ছিলেন না।
ব্লেড বাবু ও তার লোকজনের কারণে অতিষ্ট ছিলেন পল্লবীবাসী। তারা বিভিন্নভাবে তাদেরকে হয়রানি, মারধর ও চাঁদাবাজি করেছেন। গত সোমবার সন্ধ্যায় ব্লেড বাবু খুনের পর তার দলের লোকজন মোটরসাইকেল মহড়া দিয়েছেন। তারা মুসাকে দেখে নেবে বলেও হুমকি দিয়েছেন স্লোগান স্লোগানে। ব্লেড বাবু খুনের পর সেই এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। দুই পক্ষই এলাকার আধিপত্য ধরে রাখতে এখন মরিয়া। যদিও বাবুকে খুনের পর এখনো কোনো আওয়াজ দেননি মুসার লোকজন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তারা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। তবে ব্লেড বাবুর লোকজন প্রকাশ্যে মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দেওয়ায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর টহল ও নজরদারি জোরদারের দাবি জানিয়েছেন।
১৮ বছরে পল্লবীতে সাত খুন:
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, শাহিন উদ্দীন হত্যাকাণ্ডের পর গেল বছরের মার্চে কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হন ফয়সাল ওরফে রাসেল। রাব্বী ও সামী গ্রুপের দ্বন্দ্ব ছিল। সেই দ্বন্দ্বের বলি হন রাসেল। এরপর কিছুটা শান্ত ছিল পল্লবী। তবে শাহীনুদ্দিন খুন হওয়ার আগে পল্লবীর সিরামিকের গলির পাশে বুড়িরটেক, টেকেরবাড়িসহ আশপাশে আরও পাঁচজন বিভিন্ন সময়ে খুন হন। তারা হলেন- কলেজছাত্র চঞ্চল, শ্রমজীবী পাগলা খোকন, মুসা, মিন্টু ও আব্বাস। সব মিলে এই পল্লবীতে ১৮ বছরে একই এলাকায় ৭ খুনের ঘটনা ঘটেছে।
এলাকাবাসী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শুধুমাত্র মিরপুরের পল্লবীর বাউনিয়া মৌজায় ১৬৮ একর জমি দখলের বিরোধকে কেন্দ্র করে সাতজন খুন হয়েছেন। বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে লক্ষ্মীপুরের সাবেক সংসদ সদস্য এবং তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব আব্দুল আউয়াল প্রভাব খাটিয়ে গড়ে তোলা হ্যাভেলি প্রপার্টিজ কম্পানির জায়গাকে কেন্দ্র করে, যা এলাকাবাসীর কাছে ‘আলীনগর আবাসিক এলাকা’ প্রকল্প নামে পরিচিত।
জানা গেছে, এই প্রকল্পের জায়গাটি ৪৭ বছর আগে ঢাকা জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণ করে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ এর নাম দেন ‘স্বপ্ননগর’ আবাসিক প্রকল্প। কিন্তু সেটি দখল করেন সাবেক এমপি আউয়াল। সেই প্রকল্পে স্থানীয় শাহিনুদ্দীন ও মাইনুদ্দীনের জমি ছিল। তারা এমপি আউয়ালকে প্রকল্পের জন্য দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তারা তা ফেরত চান। এনিয়ে বিরোধ বাধে। সেটিকে কেন্দ্র করে সর্বশেষ আউয়ালের বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন শাহীনুদ্দীন। যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন সাবেক এমপি আউয়াল। সেই আউয়াল এখন কারাগারে রয়েছেন।
তার আগে খুন জন হ্যাভিলি প্রপার্টিজের হয়ে কাজ করা মমিন বক্স। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই মোহাম্মদপুর থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় তাকে। পরে পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের টেকেরবাড়ির সামাদ বক্সের ছেলে মমিন বক্সের লাশ চার দিন পর কালশী ব্রিজ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
একই বছরের ১৪ মে বুড়িরটেকে দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় বঙ্গবন্ধু কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র চঞ্চলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেই চঞ্চল হত্যার সব প্রমাণ থাকলেও আসামি গ্রেফতার হননি। এমনকি এই হত্যাকাণ্ডের বিচারও পায়নি তার পরিবার। এই খুনে জড়িত ছিলেন বিল্লাল ও খলিল নামে দুই সন্ত্রাসী। এই খলিলকে পল্লবীর লোকজন কসাই খলিল নামে বেশি চিনে থাকেন।
এছাড়াও এই পল্লবীতে গেল ১৮ বছরে আরও তিনজন রহস্যজনকভাবে খুন হয়েছেন। এর মধ্যে পাগলা খোকন ও ডি-ব্লকের মিন্টুর লাশ পাওয়া যায় মাছের খামারের মধ্যে। ৯ বছর আগে খুন হন কালাপানির মুসা। মুসার আগে ডিওএইচএস সড়কে খুন হন পাকিস্তানি মোহাম্মদ আলী। মুসার লোকজনই তাকে হত্যা করেছিল বলে ধারণা এলাকাবাসীর। ২০০৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সিরামিকের পেছনে আব্বাস নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেই আব্বাস হত্যায় পরে মূল আসামিরা আর গ্রেফতার হননি। মামলাটিও ভাটা পড়ে যায়। জানা গেছে, জমি দখলে নিতেই আব্বাসকে হত্যা করা হয়েছিল। এই মামলার বাদী আব্বাসের ভাইয়ের নামে ১৩ মামলা দিয়ে তাকে শহর ছাড়া করা হয়। পরে ভয়ে তার স্বজনরা আর সেই মামলার বিষয়ে খোঁজ নেননি।
পল্লবী জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এসি) পহন চাকমা ঢাকা মেইলকে বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে যেসব চাঁদাবাজি ও ভয়ভীতির আমরা খবর পাচ্ছি সেগুলো আসলে ওইসব ব্যক্তিদের নাম করে করা হচ্ছে কিনা সেটার সত্যতা পাচ্ছি না। তবে পল্লবীতে যারা অপরাধী তাদের আমরা ইতোমধ্যে গ্রেফতার ও নজরদারিতে রেখেছি।
পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা প্রায়ই অভিযান চালাচ্ছি। এলাকার বড় বড় সন্ত্রাসীদের ইতোমধ্যে আমরা ধরে ফেলেছি। এই এলাকায় যারা কিশোরগঞ্জের নেতৃত্ব দিত তাদের সবকটিকে আমরা ধরতে সক্ষম হয়েছি।
এমআইকে/ইএ