images

জাতীয়

ছোট ভুলেই বড় দুর্ভোগ!

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

০৫ জুন ২০২২, ০৯:১৯ এএম

রাস্তায় বা ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে গরমে একটু ক্ষুধা ও পিপাসা পেয়েছে, সাথে থাকা ব্যাগ থেকে একটি চিপসের প্যাকেট ও পানি বা কোল্ড ড্রিংক্স বের করে খেলাম। পরে সেই প্যাকেট রাস্তায় ফেলে দিলাম। আবার পানির বোতলটিও ছুড়ে মারলাম সামনের দিকে। একবার খেয়ালও করলাম না, আমার ফেলে দেওয়া চিপসের প্যাকেট ও প্লাস্টিকের বোতল একসময় গড়িয়ে গড়িয়ে ড্রেনে গিয়ে পড়বে। এভাবে ছোট ছোট আবর্জনা জমতে জমতে একসময় ড্রেনটাই অকার্যকর হবে। তখন তৈরি হবে জলাবদ্ধতা। এতে হাজারো মানুষকে বড় দুর্ভোগে পড়তে হবে।

আমরা দৈনন্দিন যে প্লাস্টিক ব্যবহার করে থাকি একটা পর্যায়ে গিয়ে তার সর্বশেষ গন্তব্য হচ্ছে সাগর-মহাসাগর। আর এই প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর। প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। এই প্লাস্টিক আমাদের যে কী পরিমাণ ক্ষতি করছে তা কল্পনাও করা যায় না।

গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের ব্যবহৃত এসব ছোট ছোট প্লাস্টিক জমা হয়ে সমুদ্রতলে বিশাল স্তর তৈরি হচ্ছে। শুধু একটি মহাসাগরেই বর্তমানে প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তরের আয়তন প্রায় ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার। যা প্রায় ১০টি বাংলাদেশের সমান।

শুধু চিপস বা বিস্কুটের প্যাকেট বা পানির বোতলই নয়, প্রায় সময় বাসার নানা স্থানে বা ছাদের কোণে ফেলে রাখা হয় ডাবের খোসা, গাড়ির টায়ার, অব্যবহৃত আসবাবপত্র। যেখানে বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি জমে বসবাস শুরু করে এডিস মশা। যে মশা ছড়িয়ে পড়ে পুরো মহল্লায়। ঘরে ঘরে শুরু হয় ডেঙ্গুসহ নানা মশাবাহিত রোগ।  

রাজধানীতে জলবদ্ধতা এডিস মশাসহ নানা কারণে আমরা শুধু সিটি করপোরেশন বা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই দোষারোপ করে থাকি। অথচ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এমন ছোট ছোট ভুলগুলোই একসময় বড় আকার ধারণ করে মহাদুর্ভোগে পরিণত হচ্ছে। ময়লা আবর্জনা, প্লাস্টিকের বোতল বা পলিথিনের প্যাকেট নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা খুব কঠিন বা কোনো কষ্টকর কাজ নয়। আমাদের সামান্য অবহেলার কারণেই এমনটা হয়ে থাকে।

EN1

রাজধানীর মুগদা এলাকায় বাজার মসজিদের সামনের রাস্তায় প্রায় সময় পানি জমা হয়ে থাকে। সিটি করপোরেশনের ড্রেন সংস্কার কর্মীরা মাঝে মাঝে ড্রেন পরিষ্কার করে দিয়ে যান। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার একই অবস্থা দেখা যায়। গত দুই দিন আগে পরিচ্ছন্নকর্মীরা ড্রেন পরিষ্কার করলে সেখানে দেখা যায় ময়লা আবর্জনার অর্ধেকই প্লাস্টিক জাতীয় বস্তু। পরিচ্ছন্ন কর্মীদের একজন বলেন, এসব প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন, কাগজ জমা হয়েই ড্রেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে পানি যেতে না পেরে তা উপচে ম্যানহোল দিয়ে রাস্তায় চলে আসছে।

রাজধানীর গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে একটু সামনের দিকে ফুটপাত বসেছে কাপড় জুতাসহ বিভিন্ন জিনিসের দোকান। সেই ফুটপাতের ধার ঘেঁসে অনেক জায়গায় ফেলা হয়েছে দোকানের আবর্জনা। যার বেশিরভাগই প্লাস্টিকের মতো অপচনশীল বস্তু। আবর্জনা স্তুপের পাশেই দেখা গেছে ড্রেনের ম্যানহোল। অনেক আবর্জনা গিয়ে পড়ছে ম্যানহোলে। এটা শুধু গুলিস্তান এলাকাই নয়। রাজধানীর প্রায় প্রতিটা ফুটপাতেই এমন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।
ফুটপাতে পার্কে যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলা নিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজনের সাথে। সবাই স্বীকার করছেন এটা একটা খারাপ অভ্যাস। তবে যথাস্থানে ডাস্টবিন না থাকাকেও দায়ী করছেন তারা। কমলাপুর এলাকায় পথচারী ফিরোজ বলেন, ‘আমাদের পাবলিকেরও একটা দোষ আছে, যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলতে ফেলতে খারাপ অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু পাবলিক কী করবে বলেন! আবর্জনা ফেলার জন্য আশপাশে কোথাও ডাস্টবিন পাওয়া যায় না। কাজেই যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলতে হয়।’

হাবিব নামের আরেকজন বলেন, ‘এভাবে যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলা যদিও উচিত না, তবে চলতে ফিরতে ময়লা আবর্জনা কোথায় ফেলবো? যেখানেই ফেলি পরিচ্ছন্ন কর্মীরা তো এসে নিয়ে যাবে। যদি সব জায়গায় ডাস্টবিন থাকতো তবে সুবিধা হতো।’

EN2

দূষণের শুরুটা হয় মূলত নাগরিকদের হাত দিয়েই। সামান্য অবহেলা ও অলসতার কারণে ছোট ছোট বিষয়গুলো একসময় বড় আকার ধারণ করছে। গবেষকরা বলছেন, এসব প্লাস্টিক ময়লা আবর্জনা শুধু ড্রেনেজব্যবস্থাকেই নষ্ট করছে না, এসব প্লাস্টিক দূষণের কারণে আমাদের জীবনেও অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই) বিভাগের অধ্যাপক ড. তোফাজ্জল ইসলামের গবেষণা থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৩৮১ কোটি টন প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ হচ্ছে একবার ব্যবহারযোগ্য (সিঙ্গেল ইউজ)। শুধু শতকরা ৯ ভাগ পুনর্ব্যবহার করা হয়। বর্তমান ধারা চলতে থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ পৃথিবীতে প্লাস্টিকের দ্রব্য উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হবে।

শুধু সমুদ্রের তলদেশ নয়, সমুদ্রের পানির উপরিস্তরের প্রায় শতকরা ৮৮ ভাগ কম-বেশি প্লাস্টিকদূষণে দূষিত। প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করছে প্লাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন ব্যাগ। প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিক ব্যাগ আমরা ব্যবহারের পর ফেলে দিচ্ছি। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর প্লাস্টিক ব্যাগ বর্জ্য ৫০ হাজার কোটি। প্রতি বছর ৮৩০ কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ ও প্লাস্টিকের টুকরা আমরা অসচেতনভাবে সমুদ্রসৈকতে ফেলে আসছি। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ সালে সমুদ্রে মাছের সংখ্যার  চেয়ে প্লাস্টিকের দ্রব্য ও কণার সংখ্যা বেশি হবে।

EN3

অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল সাইন্স এজেন্সি সিএসআইআরও এর এক জরিপে বলা হয়েছে, প্রতি বছর সমুদ্রের তলদেশের আনাচে-কানাচে বিশাল পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক জমছে, যা দূষণ বৃদ্ধি ছাড়াও সৈকতে জঞ্জাল সৃষ্টি করছে এবং প্রাণীদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে। প্লাস্টিকের দূষণ অ্যান্টার্কটিকার গভীরতম অঞ্চলেও পাওয়া গেছে। সমুদ্রের তলদেশে এধরনের প্লাস্টিকের স্তর সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুব কমই। সমীক্ষা বলছে, ভাসমান বা ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিকের চেয়ে ৩৫ গুণ বেশি রয়েছে সাগরের নিচে।

এ বিষয়ে  নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আকতার মাহমুদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আবর্জনার কারণে যে জনদুর্ভোগ এটা সমাধানের জন্য নাগরিক ও নগর কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন। একজন নাগরিকের যেমন উচিত যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলা। আমরা প্রায় দেখি বিভিন্ন দোকানপাটের সামনে আবর্জনার স্তুপ হয়ে থাকে। এতে ড্রেনেজব্যবস্থা কার্যকারিতা হারায়। তারা যদি সেটা বস্তাবন্দি বা অন্য কোনো উপায়ে সংরক্ষণ করে যথাস্থানে ফেলে তাহলে এই ধরনের সমস্যা হয় না। আর নগর কর্তৃপক্ষের উচিত যথারীতি তদারকি করা।’

এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘এজন্য আমরা কয়েক বছর ধরে একটা পরামর্শ দিয়ে আসছি, সেটা হলো প্রত্যেক রাস্তায় বা এলাকাভিত্তিক একজন করে স্ট্রিট ম্যানেজার বা সড়ক ব্যবস্থাপক নিয়োগ করা যেতে পারে। যে সার্বক্ষণিক তদারকি করতে পারে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে এই সমস্যা সমাধান হবে আশা করছি।’

টিএই/জেবি