কাজী রফিক, মাহফুজ উল্লাহ হিমু
১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৬ এএম
স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মাধ্যমে শেষ হয়েছে রক্তাক্ত জুলাই। তবে যুদ্ধ শেষ হয়নি ২৪-এর বহু যোদ্ধার। হাসিনা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তার দলের নেতাকর্মীদের হামলায় আহতদের অনেকেই এখনও হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যু শয্যায়। অঙ্গ হারিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন অসংখ্য আহত ব্যক্তি। এদের মধ্যে অন্তত ৬০ জন লড়ছেন চোখের আলো ফিরে পেতে।
ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম তাদের মধ্যে একজন। জুলাই আন্দোলনের শুরু থেকেই মাঠে ছিলেন সাইফুল ইসলাম। ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি লাগে চোখে। নিভে যায় বাঁ চোখের আলো। চোখের আলোর সঙ্গে সাইফুল হারিয়েছেন চাকরি। বর্তমানে তিনি রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
হাসপাতালটিতে ভর্তি এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, গত ৪ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়েছি। শরীরে একাধিক গুলি লেগেছিল। স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর ৬ আগস্ট এখানে ভর্তি হয়েছি। এরপর মোট তিনটা অপারেশন হয়েছে। তবে বা চোখের দৃষ্টি এখনও অস্পষ্ট। শুধুমাত্র অবয়ব বুঝতে পারি। হাসপাতাল থেকে তৃতীয়টাকে শেষ অপরেশন বলে দিয়েছে। এখন ওষুধের মাধ্যমে পরবর্তীতে যতটা উন্নতি হয়।
তবে তিনি আরও চেষ্টা করতে চান। দেশি-বিদেশি চিকিৎসকের মাধ্যমে আরও উন্নত চিকিৎসা চান। যেন যে কোনোভাবে তিনি তার হারানো স্বাভাবিক দৃষ্টি ফেরত পান।
রিয়াদের মতো জুলাই অভ্যুত্থানে আহত সব রোগীর এটিই চাওয়া। তারা সবাই তাদের স্বাভাবিক দৃষ্টি ফেরত চান। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে যেখানে গেলে তারা সুস্থ হবেন সেই দেশে পাঠানোর দাবিও তাদের। তবে হাসপাতালের সেবার মান ও আন্তরিকতা নিয়ে সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছেন তারা।
একাধিক আহত ব্যক্তি জানান, প্রথমদিকে খাবারের মান অত্যন্ত খারাপ ছিল। কিন্তু বর্তমানে থাকার পরিবেশ ও খাবারের মান বেড়েছে। হাসপাতাল পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী প্রতিদিন একবার করে আমাদের খোঁজ খবর নেন। এ সময় তারা চিকিৎসা সমন্বয়ক ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রোবায়েত রাজের প্রশংসা করেন।
এদিকে বর্তমানে হাসপাতালের সেবা নিয়ে আহতরা সন্তুষ্ট থাকলেও অভিযোগ রয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে। অনেকের মতে সরকার তাদের পর্যাপ্ত খোঁজ-খবর নিচ্ছে না। তেমনই একজন তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী জাহিদ (ছদ্মনাম)। ঢাকা মেইলের কাছে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এখানে যারা ভর্তি আছি, আমরা সবাই আন্দোলনের ফ্রন্ট লাইনে ছিলাম। আমরা যদি শহীদ হতাম তাহলে হয়তো সরকার আমাদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতো। কিন্তু আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের প্রতিও তো সরকারের দায়িত্ব আছে। চোখের সমস্যাটা দৃশ্যমান না। আমাদের কাউকে দেখে আপনার মনে হবে না, আমরা চোখে দেখি না। আমাদের আর দশজনের মতো সুস্থ মনে হবে। কিন্তু আমরা চোখ হারিয়েছি। আমি আমর একটা চোখ সম্পূর্ণ হারিয়েছি। আমি জানি আমি আর চোখে দেখব না। কিন্তু এখানে আরও অনেকে আছে যাদের হয়তো দেশের বাইরে নিয়ে গেলে চোখ ভালো হবে। কিন্তু তাদের নেওয়া হচ্ছে না। আবার অনেকের পুনর্বাসন প্রয়োজন সেক্ষেত্রেও আমরা কর্যকর পদক্ষেপ দেখছি না।
পরিবেশ উন্নয়নে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে
চক্ষু বিজ্ঞানে ভর্তি রোগীদের সেবায় সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চাইলে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রোবায়েত রাজ ঢাকা মেইলকে বলেন, এখানে চিকিৎসাধীন সব রোগীর সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সবধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল পরিচালক নিয়মিত তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। আমি সরকারি কোনো সুবিধা ছাড়াই নিজ উদ্যোগের তাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমি নিজে একজন ফ্রন্ট লাইনার। আমার বন্ধু মুগ্ধ শহীদ হয়েছে। আমি নিজ খরচে প্রতিদিন হাসপাতালে আসি। তাদের সব ধরনের সুবিধা-অসুবিধা লক্ষ্য রাখছি।
সেবার মান বাড়াতে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথমদিকে তাদের খাবারের মান নিয়ে সমস্যা ছিল। যে খাবার দেওয়া হতো তা মুখে নেওয়া যেত না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে বাবুর্চি পরিবর্তনসহ খাবারের মান বাড়িয়েছি। প্রতিদিন আমি নিজে সে খাবার চেক করে তারপর আহতদের জন্য পাঠাই। হাসপাতালের টয়লেটগুলো ব্যবহারের উপযোগী ছিল না। সবকয়টা টয়লেট পরিস্কার করিয়েছি। এমনকি নতুন কমোডের ব্যবস্থাও করেছি।
চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি রাখা হচ্ছে না
চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের এখানে বর্তমানে ৬০ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। তাদের বেশিরভাগের চোখে দুইবার অপারেশন হয়েছে। কারও কারও তিনবারও অপারেশন হয়েছে। এর মধ্যে দুইজন রোগীর রেটিনার অপারেশন বাকি আছে। আমাদের এখানে ভর্তিদের মধ্যে দুই চোখে স্বল্প দৃষ্টিতে ভুগছেন তিনজন রোগী। আর বাকি প্রত্যেকে এক চোখে গুলিবিদ্ধ।
সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, রোগীদের প্রায় পত্যেকের আঘাত অত্যন্ত মারাত্মক। বেশিরভাগ রোগী মেটালিক পিলেট বা রিয়েল বুলেট দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের চোখের ভেতর রক্তক্ষরণ হয়েছে। অনেকের রেটিনা ছিড়ে গেছে। তাদের একদম স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাটা কঠিন। তবে কিছু রোগী চিকিৎসার পর অনেকটা ভালো দেখতে পারছেন। কিছু রোগীর চোখের আলো ফিরে আসেনি। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা চেষ্টা করেছি এবং করে যাচ্ছি।
ফ্রান্স, চীন, নেপালসহ বেশ কিছু দেশ থেকে চিকিৎসকরা এসেছিলেন জানিয়ে সুলতানা নীলা বলেন, তারা আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে একমত জানিয়েছেন। আমরা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে তাদের রিপোর্ট ও চিকিৎসা প্রসিডিউর নিয়ে বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলেছি।
‘আহতদের চোখের আলো ফিরিয়ে আনতে আমরা চেষ্টার ঘাটতি নেই। তবে আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে, চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও কিছু সীমাবন্ধতা রয়েছে’—যোগ করেন নীলা।
তিনি আরও বলেন, আহতরা যখন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে এসেছিল তখন তাদের প্রাইমারি রিপেয়ার করা হয়। এরপর তাদের রেটিনা অপারেশন করা হয়েছে। আমরা প্রায় ৩০০ রোগীর রেটিনা অপারেশন করেছি। কিছু রোগীর অপটিক নার্ভেও সমস্যা ছিল।
ডা. যাকিয়া সুলতানা বলেন, রেটিনা অত্যন্ত সেনসেটিভ একটা অঙ্গ, এটি রিজেনারেট হয় না। ফলে সেখানে আঘাতপ্রাপ্ত হলে তার রিকোভারিটা সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় আমাদের চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকের ভালো ভিশন এসেছে। তবে বেশিরভাগের তা হয়নি। একটা গ্রুপ আছে যাদের চোখ ছোট হয়ে গেছে।
এমএইচ/ইএ