images

জাতীয়

দিনে দিনে ভয়ংকর হয়ে উঠছে হিজড়ারা

বোরহান উদ্দিন

০২ জুন ২০২২, ০৭:৫৮ এএম

দিন দিন রাজধানী ঢাকায় বাড়ছে হিজড়াদের উৎপাত। কারও সন্তান হওয়ার খবর শুনলে তারা দলবেঁধে হানা দিচ্ছে বাসাবাড়িতে। খেয়ালখুশি মতো নিচ্ছে চাঁদা। আবার প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হলেও দিতে হচ্ছে তাদের টাকা। কখনও গণপরিবহণে, কখনও রিকশা-সিএনজি অটোরিকশা আটকে চাঁদা নিচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষেরা।

অনেক সময় অনুনয় বিনয় করে ছাড় পাওয়া গেলেও মাঝেমধ্যেই ভয়ংকর হয়ে ওঠে হিজড়ারা। প্রতিবাদ করলে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হতে হয় তাদের হাতে। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা তো এদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক সময় স্ত্রী-সন্তানদের সামনে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে চাঁদা নেয় হিজড়ারা।

গত সোমবার (৩০ মে) ঢাকার রাস্তায় চাঁদা না পেয়ে ব্যস্ত সড়কে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে এক হিজড়া। এতে বেকায়দায় পড়েন জরুরি প্রয়োজনে প্রাইভেটকার নিয়ে বের হওয়া মানুষটি।

hijra

দিনেদুপুরে প্রকাশ্যে এমন ঘটনা দিনের পর দিন ঘটলেও সবাই যেন অসহায়। এদের সঙ্গে ঝামেলায় যেতে চান না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তাই বিপদে পড়ে এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েও খুব একটা লাভ হয় না। তবে বাসা বাড়িতে নতুন সন্তান হওয়ার পর হানা দিলে ৯৯৯ এ ফোন পেয়ে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের এগিয়ে আসার উদাহরণ আছে।

সমাজসেবা অধিদফতরের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যে (১৫ জুলাই ২০২০) দেখা যায়, বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার ৯৩ জন। বাস্তবে এ সংখ্যা চার গুণেরও বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যাদের বেশিরভাগ অবস্থান করেন ঢাকায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমাজসেবা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের কাছে ঢাকায় কত হিজড়া আছে এর পরিসংখ্যান সেভাবে নেই। তবে সারাদেশের তথ্য অনুযায়ী জন্মগত হিজড়াদের সংখ্যা ১১ হাজার ৯৩ জন। কিন্তু নানাভাবে হিজড়া সেজে তারাও নিজেদের হিজড়া দাবি করে আসছে। এক্ষেত্রে সংখ্যা আরও বাড়বে।’

জানা যায়, হিজড়ারা একঘরে জীবন থেকে মুক্তি ও অর্থনৈতিক সংকট মেটাতে শহরমুখী হচ্ছে। এই জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের পাইলট কর্মসূচি হিসেবে ২০১২-২০১৩ অর্থবছর থেকে দেশের সাতটি জেলায় হিজড়া উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে যার বরাদ্দ ছিল ৭২ লাখ ১৭ হাজার টাকা। প্রতি বছরের ধারাবাহিকতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ পাঁচ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। 

স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে চার স্তরে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। ৫০ বছর বা তদুর্ধ বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ ভাতা জনপ্রতি মাসিক ৬০০ টাকা।

hijra

এছাড়াও ১৮ বছর বয়সের ঊর্ধ্ব কর্মক্ষম ব্যক্তিদের ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণোত্তর অফেরতযোগ্য আর্থিক সহায়তা ১০ হাজার টাকা প্রদান করে থাকে। যদিও তৃতীয় লিঙ্গের এ জনগোষ্ঠীর অনেকেরই দাবি, এসব সুবিধা পাচ্ছে না তারা।

অন্যদিকে গত বাজেটে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে চাকরি দিলে প্রতিষ্ঠানের করপোরেট করহারে ছাড় মিলবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল- তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী থেকে কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের জনবলের ১০ শতাংশ বা কমপক্ষে ১০০ কর্মী নিয়োগ দেওয়া হলে করপোরেট করে ৫ শতাংশ ছাড় বা ওই কর্মীদের পরিশোধিত বেতনের ৭৫ শতাংশ—এই দুইয়ের মধ্যে যেটি কম তা প্রযোজ্য হবে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগ্রহ থাকলেও তারা হিজড়া জনগোষ্ঠীর কর্মী পাচ্ছেন না।

hijra

এদিকে হিজড়ারা যখন মানুষের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা নিতে ব্যস্ত তখন তাদের জন্য সম্প্রতি এক সুখবর নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত এপ্রিলে এনবিআরের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে কাজ করা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটিকে দান বা অনুদান দিলে ওই টাকা করমুক্ত। দান ও অনুদানকারী ব্যক্তি নয়, করমুক্ত সুবিধা পাবে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি।

আদেশে বলা হয়, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ব্যাংক সুদ আয় ব্যতীত সবধরনের দান ও অনুদান বাবদ প্রাপ্ত আয় এবং হিজড়া ও লিঙ্গবৈচিত্র্য জনগোষ্ঠীর উন্নয়নমূলক কাজ থেকে আয়ের ওপর কোনো কর বসবে না। তবে শর্ত হলো, এই আয় হিজড়াদের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে।

এর আগে বন্ধু সোসাইটির বাড়ি ভাড়ার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়। বর্তমানে যেকোনো স্থাপনা ভাড়ার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আছে।

hijra

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবু তালেব ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কল্যাণমুখী আর উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে এরকম ভিক্ষুক আর হিজড়ার উৎপাত বিশ্বের অন্য কোনো দেশে আছে কি না আমার জানা নেই। থাইল্যান্ডে আর ভারতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তারা রাস্তার আশে-পাশে বসে থাকে। যার যা সামর্থ্য সে  অনুযায়ী দেন। দিলে কুর্নিশ করে ও সালাম আদাব দিয়ে সম্মান জানায়।’

হিজড়াদের হাতে নাজেহাল হচ্ছেন অনেকে

সোহেল রানা নামের একজন জানিয়েছেন, রাজধানীর বলাকা বাসে করে সাতরাস্তা থেকে বনানী গেলে প্রতিদিনই হিজড়াদের খপ্পরে পড়তে হয়। একে তো বাসের ভাড়া দিতে হয়, তারপর এদের চাঁদাবাজি।

হিজড়াদের হাতে এক আত্মীয়ের নাজেহালের কথা বলতে গিয়ে নাহিয়ান নামের একজন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার এক ভাই ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় ট্রেনে হিজড়াদের খপ্পরে পড়ে। বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে ওর গায়ে হাত তোলে। সাথে থাকা ওর স্ত্রী ও সন্তানরা খুব ভয় পেয়েছে।’

একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক মাহবুব জুয়েল নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, প্রথম সন্তানের জন্মের পরে বাসায় ঢুকে জোর করে ১১ হাজার টাকা নিয়েছে হিজড়ারা। টাকা দেওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের যে আচরণ ছিল তা মনে পড়ল এখনও কষ্ট লাগে।

hijra

পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা বাহাউদ্দিন জানান, তার বোন বাচ্চা হওয়ার পর বেড়াতে এসেছিলেন বাসায়। সেখানে খবর পেয়ে হিজড়ারা হানা দেয়। প্রায় তিন ঘণ্টা বাসায় তাণ্ডব চালিয়ে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে ১০ হাজার টাকা আদায় করে ছাড়ে। তিনি জানান, বিভিন্ন বাসা-বাড়ির দারোয়ানদের সঙ্গে হিজড়াদের যোগসাজস থাকে। কোনো বাসায় বাচ্চা হলে দারোয়ানরাই মূলত হিজড়াদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়। এক্ষেত্রে দারোয়ানরাও ভাগ পেয়ে থাকে।

গাড়ি আটকে হিজড়াদের চাঁদা নেওয়ার ছবি পোস্ট করে মাহমুদ কমল নামে একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘বুঝতে পারছেন কিছু? শহরটার হয়রানি দিন দিন কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে! রুখবে কে এদের?’

সমাজ সেবা অধিদফতরের উপপরিচালক (বেদে, অনগ্রসর ও হিজড়া জনগোষ্ঠী) মো. শাহ জাহান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরাও দেখেছি রাস্তায় হিজড়াদের উৎপাত বেড়েছে। আমরা তালিকাভুক্ত যারা আছে তাদের জন্য সরকারের যেসব উদ্যোগ আছে সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। যারা ছাত্র তাদের বৃত্তি, যারা কর্মক্ষম তাদের প্রশিক্ষণ দিই। কিন্তু এরা প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর চলে যায়।’

বিইউ/জেবি/এএস