নিজস্ব প্রতিবেদক
১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১২ এএম
হারুনুর রশীদ, আলোচিত দুদক কর্মকর্তা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এক মামলা করে তার ভাগ্যের চাকা খুলেছিলেন। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই, সাড়ে ১৫ বছর দুর্নীতি চালানোর পরেও হারুনের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বরং আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে তাকে নানা অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে তিনি বিত্ত-বৈভব গড়ে তোলেন। তবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং শেখ হাসিনার পতনের পর হারুনুর রশীদ নিখোঁজ হয়ে যান।
হারুন ২০০৮ সালে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুদকের সহকারী পরিচালক হিসেবে রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা করেন, যেখানে অভিযোগ ছিল, খালেদা জিয়া এতিমদের জন্য কুয়েত আমিরের সহায়তা হিসেবে দেওয়া ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ২০০৯ সালে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় এবং ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ জজ আদালত-৫ খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড দেন। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শেষে, ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট তার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১১ নভেম্বর আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে এবং সাজা বাড়ানোর রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার পৃথক লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি) মঞ্জুর করেন।
অভিযোগপত্র এবং বিচারিক আদালতের রায়ের অংশবিশেষ তুলে ধরে দুদকের আইনজীবী আসিফ হাসান আদালতকে বলেন, "এখানে টাকা আত্মসাতের কিছু দেখা যাচ্ছে না। ফান্ড মুভ হয়েছে, টাকা অ্যাকাউন্টে জমা আছে, আত্মসাতের কিছু নেই।" অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা দাবি করেছেন, তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এর ট্রাস্টি বা সুবিধাভোগী ছিলেন না এবং ব্যাংক হিসাবে জমা ২ কোটি ১০ লাখ টাকা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়ে গেছে।
অনেকে অভিযোগ করছেন, হারুনুর রশীদ ভুয়া মামলা দিয়ে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিএনপির অনেক নেতাকে ফাঁসিয়েছেন। শুধুমাত্র জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাই নয়, ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এয়ারবাস দুর্নীতি মামলাও দায়ের করেন হারুন। এমনকি বিএনপির স্থানীয় নেতারাও তার হাত থেকে রেহাই পায়নি।
রাজধানীর বাড্ডা থানা বিএনপির সহসভাপতি মনির হোসেন এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে আয়কর বিবরণীতে দাখিল করা সম্পদকে অবৈধ দেখিয়ে মামলার মাধ্যমে দীর্ঘদিন জেলে রাখা হয়। বিএনপি নেতাকর্মী কিংবা সমর্থকদের লক্ষ্য করে বারবার তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ফাঁসানো হত। এর ফলে হারুন আওয়ামী লীগের একটি পছন্দের কর্মকর্তা হয়ে উঠেন এবং একের পর এক অনৈতিক সুবিধা নেন।
দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হারুনের ভয়ানক দাপটে সবাই তখন দুদকে তটস্থ থাকতেন। এমনকি খালেদা জিয়ার রায় ঘোষণার দিন, তিনি পুরো কার্যালয়ে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলে হারুনের প্রভাব মন্ত্রী-এমপির চেয়েও বেশি ছিল। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সময়, অবসর প্রস্তুতকালীন ছুটি (পিআরএল) কাটানোর পরও হারুন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলায় লড়াই চালিয়ে যান সরকারের সুবিধা নিয়ে।
সূত্র জানিয়েছে, হারুন সরকারি সুবিধা নিয়ে নিজের জেলা ফরিদপুর শহরে দুটি বহুতলসহ একাধিক বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে পৌরসভার ৭৭/১ বাদামতলী সড়কে একটি ছয়তলা ভবন, একতলা বাড়ি এবং একটি টিনশেড বাড়ি। ২০ নম্বর রোডে ২৩-এ হোল্ডিংয়ে রয়েছে আরেকটি পাঁচতলা বাড়ি। এছাড়া ঢাকার মিরপুরে একটি ছয়তলা বাড়ি এবং আরও কিছু ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। তবে এসব সম্পদ আয়কর বিবরণীতে তিনি উল্লেখ করেননি।
তাছাড়া, শিবচর এলাকার বাখরেকান্দি এলাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে ভূমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে হারুন দেড় কোটি টাকারও বেশি উপার্জন করেছেন।
দুদক সূত্র জানায়, হারুন ১৯৭৯ সালে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর ‘সহকারী’ হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন, তবে তার যোগদানের কোনো কাগজ দুদকে পাওয়া যায়নি। ২০০৪ সালে দুদক গঠন করার আগে, ২৬৩ জনের মধ্যে হারুনসহ যাদের চাকরি বাতিল করা হয়, তাদের মধ্যে হারুন ছিলেন একজন। তবে ২০০৮ সালে, লে. জে. (অব.) হাসান মশহুদ চৌধূরী দুদক চেয়ারম্যান হওয়ার পর হারুনসহ ১১২ জনকে পুনরায় চাকরিতে বহাল করেন। এর পর থেকেই তিনি বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করেন। ২০১২ সালে, সরকার হারুনকে সহকারী পরিচালক পদে বিগত পাঁচ বছরের ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা দেয়, যা তাকে একটি পুরস্কার হিসেবেই দেখা হয়।
দুদক সূত্র আরও জানায়, ২০১৮ সালের জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার সাজার রায়ের পর হারুন পিএলআর (অবসর) যান, কিন্তু উচ্চ আদালতে রিভিউয়ের সময় তাকে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আপিল বোর্ডে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে, দুদক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে তাকে মামলা পরিচালনায় সহায়তা করতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ৫ দিনের মধ্যে তাকে ভাতাদি প্রদানেরও আদেশ জারি করা হয়। কর্মকর্তাদের মতে, মূলত হারুনকে খুশি করতে এ আদেশ জারি করা হয়েছিল।
হারুনুর রশীদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সম্পর্কে তার মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায় এবং ফরিদপুর ও ঢাকার বাসভবনে গিয়েও তাকে বা তার পরিবারের কাউকেই পাওয়া যায়নি। বাড়ির তত্ত্বাবধায়করা জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে হারুন এবং তার পরিবার বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।
এইউ