images

জাতীয়

মনিরুল দেশে নাকি ভারতে, অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:২১ পিএম

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) কাজ করা আলোচিত ও দাপুটে কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম কোথায় আছেন তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশার। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে লাপাত্তা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত এই মহাপরিদর্শক (এসবি)। শুরুর দিকে একদম চুপচাপ থাকলেও সম্প্রতি একাধিক গণমাধ্যমে মুঠোফোনে সাক্ষাৎকার দিয়ে দেশে থাকার দাবি করেছেন তিনি। অন্যদিকে অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের মনিরুলের কেনাকাটার একটি ছবি পোস্ট করে দাবি করেছেন, সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। যে কারণে আসলেই তার অবস্থান কোথায় তা নিয়ে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে।

সোমবার (১৪ অক্টোবর) মনিরুলকে নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন যমুনাতে একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। যেখানে তিনি দীর্ঘদিন পর নিজের সরকারি বাসার সামনে থেকে ঘুরে আসার কথা জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, যেকোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন এমন আশঙ্কার কথাও বলছেন পুলিশের সাবেক দাপুটে এই কর্মকর্তা।

সাক্ষাৎকারে মনিরুল বলেন, ‘আমি যেকোনো সময় গ্রেফতার হতে পারি, এটা আমি ধারণা করছি। সুষ্ঠু তদন্তে যদি সম্পৃক্ততা আসে তাহলে আমি গ্রেফতার হতে রাজি।’

নিজের অবস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কালকে (রোববার) রমনার বাসায় ঢুকতে পারলাম না। রাস্তা থেকে শুধু দেখলাম। এ বাসায় অনেক দিন থেকেছি। অথচ বাসাতে ঢুকতে পারলাম না।’

এরইমধ্যে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামকে চাকরি থেকে অবসরে পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তিনি পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছিলেন।

তবে তিনি যখন দাবি করছেন দেশেই আছেন তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে তার। যে ছবি ধরে কেউ কেউ বলছেন, তিনি ভারতে আছেন।

গত ৬ অক্টোবর মনিরুল ইসলাম ভারতে অবস্থান করছেন দাবি করে প্রবাসী বাংলাদেশি অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের দুটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন। ওই পোস্টে তিনি বলেছিলেন, ‘পলাতক এসবি প্রধান (সাবেক) মনিরুল ইসলামের অবস্থান নিশ্চিত করেছে অত্যন্ত বিশ্বস্ত সূত্র। ভারতের রাজধানী দিল্লির কনাট প্লেস (Connaught Place)-এর একটি গ্রোসারি স্টোরে আজ বিকেলে মনিরুল ইসলামকে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার সময় ক্যামেরাবন্দি করা হয়।’

আরও পড়ুন

মনিরুল-হাবিবসহ পুলিশের চার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাধ্যতামূলক অবসরে

এবার সরিয়ে দেওয়া হলো এসবি প্রধান মনিরুলকে

তিনি আরও লেখেন- ‘ওই এলাকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পলাতক বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বসবাস করছেন। বন্ধুপ্রতীম দেশ হিসেবে ভারত সরকারের উচিত হবে অনতিবিলম্বে এদের খুঁজে বের করে বাংলাদেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা। এ বিষয়ে India in Bangladesh (High Commission of India, Dhaka)-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’

Monirul2
দিল্লির একটি সুপারশপে মনিরুল। ছবি: সংগৃহীত

তবে সেই ছবি নিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন মনিরুল। তিনি বলেন, '২০২২ সালে মার্চের দিকে মালদ্বীপ গিয়েছিলাম, পরে দিল্লিতে দুই দিন অবস্থান করেছিলাম। ওই সময়ের ছবি এটি।’

কী বলছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের

মনিরুলের দাবি নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশনের সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মীর কাছে প্রশ্ন রেখে জুলকারনাইন বলেন, তিনি যে দেশে আছেন দাবি করেছেন, আপনারা কি সশরীরে সেটা যাচাই করেছেন? নাকি মনিরুলের মতো একটা অপরাধী গোছের পুলিশ কর্মকর্তার মন্তব্য সত্য হিসেবে মেনে নিলেন? গণমাধ্যম হিসেবে প্রদত্ত তথ্য যাচাই না করেই সেটা কীভাবে প্রচার করলেন? দুই দিন পর যখন মনিরুল সাফাই গাইবে 'আমি নিরপরাধ, জীবনে দুই টাকা হারাম কামাই করিনি, কাউকে নির্যাতন করিনি' তখনও কি একইভাবে তাকে কাভার করবেন? 

নিজের দাবিতে অনড় এই অনুসন্ধানী সাংবাদিক বলেন, যেই লোককে দিল্লির কেন্দ্রে ৬ অক্টোবর শারীরিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। একই লোক যদি দাবি করে তিনি নাকি দেশের বাইরে কোথাও যাননি, তাহলে সেটা ডাহা মিথ্যা ব্যতীত আর কিছুই না।

আরও পড়ুন

হঠাৎ ফেসবুকে সাবেক এসবি প্রধান মনিরুলের স্ট্যাটাস

মনিরুলের স্ত্রী অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানা ওএসডি

ছবির বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ছবির মেটা ডাটা তো আর মিথ্যা হতে পারে না। যার অর্থ দাঁড়ায় পলাতক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতেই অবস্থান করছেন এবং যমুনা টিভির সাথে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। মনিরুল বলেছেন, এই ছবি নাকি ২০২২ সালের, কিন্তু ছবির মেটা ডাটা স্পষ্ট বলছে, এটি ৬ অক্টোবর ২০২৪ এ তোলা, ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লির, কনাট প্লেসে।'

ফরেনসিক মনিরুলের ভারতে থাকার কথা নিশ্চিত করেছে দাবি করে জুলকারনাইন সায়ের বলেন, পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের বাংলাদেশে অবস্থানের দাবি মিথ্যা। অন্তত ৬ অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত তিনি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতেই ছিলেন। ৬ অক্টোবর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩৯ মিনিটে তোলা ছবির ফরেনসিক এনালাইসিস করে নয়াদিল্লিতেই তিনি ছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অবশ্য বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন, তা আমাদের জানা নেই।

এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের নামে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয় থেকে ২৫ কোটি টাকা আনার অভিযোগ ওঠার পর ফোনে এ কর্মকর্তার গত ১৮ সেপ্টেম্বর সাক্ষাৎকার নেয় একটি গণমাধ্যম। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি পালিয়ে যাইনি। পালাবও না। আমি দেশেই ছিলাম, দেশেই আছি। ভবিষ্যতে দেশেই থাকব। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারি বাসায় ফিরিনি।’ 

Monirul11
প্রশাসনের কর্মকর্তা মনিরুলের স্ত্রীকেও ওএসডি করা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

সাক্ষাৎকারে ‘পালাব না’ বলেও বর্তমানে ভারতে অবস্থান নিয়ে জানতে চাইলে ৭ অক্টোবর হোয়াটসঅ্যাপে মনিরুল ইসলাম জানান, আপনাকে তো সেদিন (১৮ সেপ্টেম্বর) ঠিকই বলেছি, মিথ্যা তো বলিনি। আপনাকে যেদিন সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম, তখন সেটাই সত্য ছিল।

পুলিশে আলোচিত-সমালোচিত মনিরুল

গোপালগঞ্জের মকসুদপুরে জন্ম নেওয়া মনিরুল ইসলাম ২০২১ সালের ১৪ মার্চ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট প্রধান থেকে এসবি প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এর আগে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার মাধ্যমে এএসপি হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন মনিরুল। তিনি গোয়েন্দা শাখায় ৯ বছর এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন।

বিসিএস ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম পরবর্তী আইজিপি হতে পারেন বলে পুলিশের মধ্যে অনেক দিন থেকেই আলোচনায় ছিলেন। গোপালগঞ্জের এই কর্মকর্তা পুলিশের একটা অংশকে অনেক দিন ধরেই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া বিরোধী মত-পথের মানুষদের ধরে এনে ‘জঙ্গি’ নাটক সাজানোর অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।

ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর তার স্ত্রী এবং বিসিএস ১৭ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা সায়লা ফারজানাকে ওএসডি করেছে সরকার। সায়লা বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের মহাসচিব। স্বামী পুলিশের বড় কর্তা হওয়ায় তিনি ব্যাপক দাপট দেখাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিইউ/জেবি