images

জাতীয়

দীপ্ত টিভির কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনায় যা জানা গেল

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

১১ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৫২ পিএম

রাজধানীর হাতিরঝিলের মহানগর প্রজেক্টের আবাসিক এলাকায় দীপ্ত টিভির সম্প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা তানজিল জাহান ইসলাম তামিমের মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদেরকে নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদও করছে। কি কারণে তারা তানজিলকে মেরেছিল, সেখানে কি কারণে এবং কার নির্দেশে গিয়েছিল নানা বিষয়। তবে এখন পর্যন্ত পুলিশের তথ্যে বেরিয়ে এসেছে, বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট ভাগাভাগির দ্বন্দ্বের কারণেই এই হত্যাকাণ্ড।

বৃহস্পতিবার সকালে আসলে কি ঘটেছিল আর কি কারণে তানজিলকে প্রাণ দিতে হলো তা জানার চেষ্টা করা হয়েছে ঢাকা মেইলের পক্ষ থেকে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে উভয় পক্ষের সাথেই কথা বলা হয়। জানার চেষ্টটা করা হয় তাদের অভিমত, অভিযোগ ও দাবির কথাগুলো।   

বিষয়টি নিয়ে নিহতের পরিবার বলছে, ফ্ল্যাট দখল করতে এসে তানজিলকে ডেভেলপার কোম্পানির লোকজন তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। 

অন্যদিকে ডেভেলপার কোম্পানির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমির মালিক জোর করে সেই ফ্ল্যাটে উঠেছিল। যাতে আদালতের আদেশ ছিল। কিন্তু সেই আদেশকে উপেক্ষা করে ফ্ল্যাট দখলে নিয়েছিল জমির মালিক ও নিহত তানজিলের বাবা সুলতান আহমেদ।

ভবনটির ম্যানেজার নুরুল আলম ঢাকা মেইলকে জানান, ফ্ল্যাটটির অর্ধেক অংশ কিনে নেওয়ার জন্য সুলতান সাহেব টাকা পরিশোধ করছিলেন। কিন্তু কিছু টাকা বকেয়া ছিল। তবে এর আগে সেই ফ্ল্যাট নেবেন না বলে ডেভেলপারকে জানালে তারা মামুনের কাছে বিক্রি করে দেন। সেই ফ্ল্যাট নিয়ে আদালত যে আদেশ ছিল তার বিপরীতে আরেকটি আদেশ এনে সুলতান আহমেদ এবং তার ছেলে ফ্ল্যাটের কাজ করছিলেন বলে দাবি করেন তিনি।

মূলত সুলতানের দ্বিমুখী কথার কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন ভবনটির মালিক থেকে সংশ্লিষ্ট সবাই।

মধ্যস্থতাকারীদের উল্টো লিগ্যাল নোটিশ
 
সম্প্রতি সুলতান আহমেদ কোম্পানিকে বকেয়া টাকা পরিশোধ না করে সেই ফ্ল্যাটে উঠে যান। বিষয়টি সমাধান চেয়ে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হাতিরঝিল ফ্ল্যাট মালিক সমিতির অফিসে একটি অভিযোগ করে। সেই অভিযোগ পাওয়ার পর সমিতি থেকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য সুলতান আহমেদকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি না গিয়ে উল্টো সমিতিকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। সেই সাথে বিষয়টি নিয়ে সমিতি কোনও কিছু বলতে পারে না এমন কথা আদালতের মাধ্যমে জানানো হয়। এরপর সমিতির নেতৃবৃন্দ বিষয়টি নিয়ে আর মাথা ঘামাননি। 

তবে সমিতির একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছে, সুলতান আহমেদ ও নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ফ্ল্যাট ভাগাভাগি দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ে অন্তত তিনবার বিচার হয়েছে। বিচারে সমিতির নেতারা সমাধানের জন্য ব্যাপক চেষ্টাও চালিয়েছেন কিন্তু সুলতান ছিলেন নাছোড়বান্দা। তিনি সাত তলার পুরো ফ্লোর তার দখল নেবেন এবং একটি ফ্ল্যাটও ছাড়বেন না বলে জানিয়েছিলেন তখন। ফলে সমাধান আর আলোর মুখ দেখেনি। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সমিতির কাছে বিচার দিয়ে সমাধান না পেয়ে তখন তারা আদালতের দ্বারস্থ হন। আদালত সেই ফ্ল্যাটে সুলতান আহমেদকে না ওঠার জন্য আদেশ জারি করে। কিন্তু সেই আদেশ ভঙ্গ করে সম্প্রতি তিনি সেখানে ওঠেন এবং কাজ শুরু করেন।

তারা আরও জানিয়েছেন, নির্মাণের শর্ত অনুযায়ী সাড়ে চারটি ফ্ল্যাট বুঝে পাওয়ার কথা সুলতান আহমেদের। সাত তলায় তিনটি ফ্ল্যাটের আড়াই ভাগ সুলতান আহমেদ এবং বাকী অর্ধেক তার কেনার কথা ছিল। কিন্তু একসময় তিনি জানিয়ে দেন কিনবেন না। তার মুখের কথার কারণে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সেটি মামুনের কাছে বিক্রি করে দেয়। যখন বিক্রি করে দেয় তখন সুলতান দাবি করতে শুরু করেন, তিনি এমন কোনও কথা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে কখনো বলেননি, এটাকে নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। 

এ বিষয়ে হাতিরঝিল ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজান পাটোয়ারী ঢাকা মেইলকে জানিয়েছেন, সুলতান আহমেদের সাথে ডেভেলপার কোম্পানির ফ্ল্যাট নিয়ে ২০২১ সাল থেকে ঝামেলা চলছিল। এ নিয়ে তারা বিচারও করে দিয়েছেন। কিন্তু বিচারে সুলতান আহমেদ কোনও সমাধান মানেননি। 

নিহতের বাবা যা বলছেন

নিহতের বাবার অভিযোগ, অন্য জমির মালিকরা ফ্ল্যাট বুঝে পেলেও তাকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে গড়িমসি করছিল ডেভেলপার কোম্পানি। এ নিয়েই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তিনি দুটি ফ্ল্যাট বুঝে পেলেও আরও একটি পাবেন কিন্তু সেটি পাননি। সম্প্রতি তিনি একটি ফ্ল্যাটে উঠে তাতে বাবা-ছেলে মিলে কাজ করছিলেন। কিন্তু মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মামুন ডেভেলপার কোম্পানির লোকজনকে ডেকে আনেন এবং তার ছেলের ওপর হামলা চালান। এতে তার ছেলে তানজিল গুরুতর আহত হলে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। 

ভুক্তভোগী সুলতান আহমেদের দাবি, ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে ফ্ল্যাট দখল করতে এসেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতের উপ-পরিচালক মামুন এবং সেটা ফ্ল্যাট ও জমি মালিকদের জোরপূর্বক জিম্মি করে।

ফ্ল্যাট দখল নাকি অন্য কিছু!

মুলত দ্বন্দ্বের শুরুটা হয় তিন বছর আগে। ফ্ল্যাট নির্মাণের সময় এক পাশে পাঁচ ফুট জায়গা ছাড়তে হবে সরকারি বিধি অনুযায়ী। বিষয়টি নিয়ে রাজউক বাদ সাধে। কিন্তু পরে কোনোভাবে বিষয়টি ম্যানেজ করে ফেলেন জমির মালিক ও ডেভেলপার কোম্পানি।

খোঁজ নিয়ে জানা জানা গেছে, ফ্ল্যাট সমস্যা নিয়ে তৎকালীন ডিবির কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের কাছেও গিয়েছিল নিহতের বাবা ও ডেভেলপার কোম্পানি। সেখানে গেলে হারুনের শ্বশুরের মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে বিচার হয়। হারুনের শ্বশুর হাতিরঝিল এলাকার ওই প্রজেক্টের ফ্ল্যাট মালিকদের নেতা। ফলে তিনি বিষয়টি সুরাহা করে দেন। 

এদিকে নিহত তানজিলের বাবা সুলতান চেয়েছিলেন ভবনটির সাততলার পুরো ফ্লোরটা তিনি নেবেন। কিন্তু তাকে দেওয়া হয়েছিল তিনতলায়। বাকী আড়াইটি সাততলায় দেওয়া হয়। কিন্তু সেটি আবার ডেভেলপার কোম্পানি তৃতীয় পক্ষ ক্রেতা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মামুনের শ্বশুরের কাছে বিক্রি করে দেয়। বিষয়টি তখন ঘোলাটে হতে শুরু করে। জোর করেই সেই ফ্ল্যাট দখলে ওঠে যান সুলতান। তখন কোম্পানি তাকে ঠেকাতে আদালতের আদেশ নিয়ে আসেন এবং সেই ফ্ল্যাটে কারও ওঠা নিষেধ ছিল। কিন্তু সুলতান সম্প্রতি জোর করে উঠে যান। তার আগে সুলতানের সাথে কোম্পানির কথা ছিল, তিনি ফ্ল্যাটটি কিনে নেবেন। ইদানিং সেটাও তিনি করছিলেন না। অথচ উঠে তিনি নির্মাণের বাকী কাজ করছিলেন। 

মামুনের চাকরি খেতে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ!

দ্বন্দ্ব থাকা ফ্ল্যাটটি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মামুনের শ্বশুর ফ্ল্যাটটি কিনেছেন। ফ্ল্যাটটি মামুন কিনতে সহায়তা কেন করেছেন এ নিয়ে ক্ষেপে যান জমির মালিক সুলতান আহমেদ। তিনি তাকে উচিত শিক্ষা দেয়া ও তার চাকরি খাওয়ার জন্য বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করেন। অভিযোগের পর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত তদন্ত করেও কোনও দোষ পায়নি মামুনের বিরুদ্ধে। তখন তারা মামুনের পক্ষেই রিপোর্ট দেন। এতে আরও ক্ষেপে যান সুলতান। ফলে সম্প্রতি এক প্রকার জোর করেই মামুনের শ্বশুরের ফ্ল্যাটে ওঠে যান সুলতান।

মামুন বলেন, আমাদের কি দোষ! আমরা ফ্ল্যাটটি কিনেছি বলে কি তিনি আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করবেন! শুধু আমার চাকরি খাওয়ার জন্য!    

ডেভেলপার কোম্পানি ও তৃতীয় পক্ষ যা বলছে

হাতিরঝিলের সেই ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান প্লেজেন প্রোপার্টি লিমিটেডের মালিক ও বিএনপি নেতা রবিউল আলম গণমাধ্যমকে জানান, সুলতান আহমেদ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ফ্ল্যাটের কাজ করছিলেন। তিনি শুধু তারা লোকজনকে গিয়ে কাজ বন্ধ করতে বলেছেন।

এছাড়াও তিনি অভিযোগ করেছেন, নিহতের বাবা সুলতান আহমেদ তার একটি ফ্ল্যাট দখলে রেখে কাজ করছিল। যা নিয়ে আদালতের আদেশও ছিল। কিন্তু সেই আদেশ তিনি মানেননি। ফলে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব।

তিনি দাবি করেন, সুলতান আহমেদকে তিনি তিন বছর আগেই ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনজন জমির মালিক তারা প্রত্যেকে সাড়ে চারটি করে ফ্ল্যাট পেয়েছেন। দুজন মালিক অর্ধেক অংশ কিনে নিয়েছেন। কিন্তু সুলতান সাত তলার একটি ফ্ল্যাটের অর্ধেক অংশ অর্থাৎ সাড়ে ৬শ বর্গফুট ফ্ল্যাটটি কেনার কথা ছিল। কিন্তু তা না কিনে তিনি দখলে রেখেছিলেন। 

তবে তার দাবি, বৃহস্পতিবার সকালে ওই বাসায় কোনও মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে আসল ঘটনা ময়নাতদন্তে বেরিয়ে আসবে বলে তিনি মনে করেন। এই ফ্ল্যাট সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে তৎকালীন ডিবি হারুন তার শ্বশুরকে দিয়ে তাকে চাপে রেখেছিল। এছাড়াও তাকে নানাভাবে হয়রানিও করা হয়েছিল। তিনি একজন ভুক্তভোগীও দাবি তার। 

তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ফ্ল্যাট কেনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতের উপ-পরিচালক মো. মামুন জানান, ফ্ল্যাটটি তার শ্বশুর কিনেছেন। তিনি শুধু শ্বশুরের বাসায় থাকেন। তিনি বৃহস্পতিবারের ঘটনার সময়ও ছিলেন না। ওই সময় কি হয়েছিল তাও তিনি জানেন না।  

তিনি আরও জানান, এ ঘটনার পর তার বাসায় নিহতের লোকজন হামলা করেছে। বাসার ভেতর ভাঙচুর চালিয়েছে। এমনকি তার বাসার সিসি ক্যামেরা ভেঙে নিয়ে গেছেন সুলতান আহমেদের লোকজন। 

পুলিশ যা বলছে

এ বিষয়ে রাতে তেজগাঁও বিভাগের এডিসি জিয়াউল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা বিষয়টি আগে কি হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত করছি না। মূলত হত্যাকাণ্ডটি কার নির্দেশে এবং কারা কারা জড়িত ছিল তা বের করার চেষ্টা করছি। তবে যেই জড়িত থাকুক না কে তাকেই গ্রেফতার করা হবে। এরই অংশ হিসেবে আজ সন্ধ্যায় আমরা হাতিরপুলে ডেভেলপার কোম্পানির মালিক রবিউল আলমের বাসায় অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু ওনারা বাসায় কেউ ছিলেন না। তবে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। 

এদিকে শুক্রবারে সকালে তেজগাঁও ‍বিভাগের ডিসি রুহুল কবির খান গণমাধ্যমকে বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ হলো বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট ভাগাভাগির দ্বন্দ্ব। তবে এ ঘটনায় বিএনপি নেতা রবিউলের সংশ্লিষ্ট পেলে তাকেও তারা গ্রেফতার করবেন। 

এমআইকে/এএস