images

জাতীয়

পুলিশের আলোচিত অনেক কর্মকর্তা এখনও কাজে যোগ দেননি

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:০৯ পিএম

গত জুলাই ও আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন দমাতে যেসব পুলিশ অফিসার সরাসরি ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের অনেকেই কাজে যোগ দেননি। কেউ কেউ কাজে যোগদান করবেন না বলেও জানা গেছে। তবে আন্দোলন দমাতে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা নানা ভূমিকা রেখেছেন এবং মাঠে সরাসরি কাজ করেছেন তাদের তালিকা ইতিমধ্যে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সংগ্রহ শুরু করেছে। এসব কর্মকর্তাকে আন্দোলন দমানোর মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রথমে আলোচনায় আসেন সাবেক ডিএমপির ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ ও ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার। ২০১১ সালে ৬ জুলাই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ব্যবস্থা বাতিলের প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছিল বিএনপি। সেদিন জাতীয় সংসদের সামনে হরতালের সমর্থনে মিছিল করতে গেলে তৎকালীন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুকের ওপর ব্যাপক লাঠিচার্জ ও এলোপাতাড়ি মারধর করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ডিসি হারুন ও বিপ্লব। আলোচিত এই ঘটনার পর পুলিশের এই দুই কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়। সর্বশেষ হারুন ডিএমপির ডিবি প্রধান হয়ে পরে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার এবং বিপ্লব ডিএমপি থেকে ডিবিতে বদলি হন।

কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এই দুজন গা ঢাকা দিয়েছেন। হাসিনা সরকারের পতনের দিন পুলিশ সদর দফতরের দেয়াল টপকে ডিবির হারুন পালিয়ে যান বলে জানা গেছে। সেদিন থেকে ডিবি হারুন ও ডিসি বিপ্লবকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কোথায় আছে, তা নিয়ে পুলিশের কেউ কিছু বলতে পারছে না। অনেকের ধারণা করছে, তারা এখনও সেনা হেফাজতে রয়েছেন। আওয়ামী সরকারের পতনের পর জীবন বাঁচানোর তাগিদে সেনা হেফাজতে আশ্রয়ে নিয়েছিলেন ৬০০ জনের বেশি জনপ্রতিনিধি, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী ও সরকারী চাকরীজীবী।

এর বাইরে ডিবির ডিসি মশিউর রহমান, নুরুন্নবী খন্দকার, ওয়ারীর ডিসি ইকবাল হোসেন, মতিঝিলের সাবেক ডিসি আনোয়ার হোসেন, গুলশানের সাবেক ডিসি মোস্তাক আহমেদ, তেজগাঁওয়ের ডিসি এইচএম আজিমুল হক, ডিবির মতিঝিলের ডিসি রাজীব আল মাসুদ, কুমিল্লার সাবেক এসপি (বর্তমানে সিলেটের এসপি) আব্দুল মান্নান, ঢাকারে জেলার এসপি আসাদুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুরের সাবেক এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল, গোপালগঞ্জের সাবেক এসপি আল বেলী আফিফা, গাজীপুরের সাবেক এসপি ও এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের ভায়রা কাজী শফিকুল আলম, সাবেক এআইজি মাল্টিমিডিয়া এবং শেরপুর ও জামালপুরের সাবেক এসপি মো. কামরুজ্জামান অন্যতম। এসব কর্মকর্তা বিভিন্ন সময়ে আলোচিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

তবে ঢাকার ডিসিদের মধ্যে সম্প্রতি আলোচনায় আসেন ওয়ারীর সাবেক ডিসি ইকবাল হোসেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ী ও শনিরআখড়া এলাকায় আন্দোলনকারীদের দমাতে সরাসরি গুলির নির্দেশ দেন ইকবাল।

ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, এসব কথা নিজের মুখেই স্বীকার করছেন ইকবাল। ভিডিওতে ওই পুলিশ সদস্যকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, গুলি করে করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়। তবে সেই ডিসি ইকবাল হোসেন এখন কারাগারে।

অন্যদিকে ডিবির গুলশান ও সবশেষ লালবাগের ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মশিউর রহমানও ছিলেন আলোচিত। নানা বিতর্কিত অভিযান চালিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। সবশেষ যাত্রাবাড়ীতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে এক ব্যবসায়ী নিহত হওয়ার ঘটনায় ড্যাফোডিল ইন্সটিটিউট অফ আইটির শিক্ষার্থী মাসরুর হাসানকে তার বাসা থেকে ডিবির সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়।

পরিবারটি জানায়, ডেমরার বড়ভাঙায় ফজর নামাজের পর নিকটাত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন মাসরুর। গত ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার ওই বাসার নিচ থেকে অজ্ঞাত কিছু ব্যক্তি ডিবি পরিচয়ে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে তাকে নিয়ে যায়। একইসঙ্গে তার বাবা ও ভাইকেও তুলে নেওয়া হয়। আরেক ভাই ও মামা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ করতে গেলে তাদেরও সেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়। এ কাজে নেতৃত্ব দেন ডিসি মশিউরের টিমের অন্যতম এডিসি খন্দকার আরাফাত লেলিন। তবে ২৫ জুলাই মাসরুরকে আটক করা হলেও ১২ দিন পর তাকে ও তার বাবা ভাইকে গ্রেফতার দেখানো হয়। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকরা সেই সময় ডিসি মশিউরের কাছে জানতে চাইলে তিনি নানাভাবে হুমকি দিতে শুরু করেন। এখন সিলেটে বদলি হওয়া সেই ডিসি মশিউর নিজেকে বিএনপি-জামায়াত লোক দাবি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

জামালপুরের সাবেক এসপি কামরুজ্জামান নানা দুর্নীতি করে তার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে নিজের নামে একাধিক জমি, বহুতল ভবন ও ফ্লাট করেছেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হলেও সেই কামরুজ্জামানের কিছুই হয়নি। এখনও তিনি বহাল তবিয়তে আছেন।

এর বাইরে আরও অনেকে ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নানা অপরাধ করেছেন। তাদের মধ্যে ডিএমপির ডিবি রমনার সাবেক ডিসি আশরাফুল ইসলাম, সাবেক ডিসি (হেডকোয়ার্টার্স) তানভির সালেহীন ইমন, অতিরিক্ত ডিআইজি (সাবেক ডিবি ডিসি) মতিউর রহমান, ডিবির সাবেক ডিসি মাহফুজুল আল রাসেল, জাহিদুল তালুকদার, মতিঝিলের সাবেক ডিসি হায়াতুল ইসলাম, উত্তরার সাবেক ডিসি আশরাফুল আজিম, হাফিজ আল ফারুক, মাহাবুব-উজ-জামান, জাফর হোসেন প্রমুখ।

এছাড়া এডিসি হিসেবে যারা ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে কঠোর ভূমিকা রেখেছিলেন তারা হলেন— এডিসি নুরুল আমিন, গোবিন্দ চন্দ্র, শাহেন শাহ, হাফিজ আল আসাদ, মুহিত কবির সেরনিয়াবাত, শহিদুল ইসলাম, জুয়েল রানা, হাসান আরাফাত, নাজমুল ইসলাম, সাব্বির রহমান, আফজাল হোসেন টুটুল, ফজলে এলাহী, রওশানুল হক সৈকত এবং শাকিল মোহাম্মদ শামীম।

এসি হিসেবে যারা ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে কঠোর ভূমিকা রেখেছিলেন তারা হলেন— রেফাতুল ইসলাম রিফাত, শাহীনুর রহমান, শহীদুল হক, মিজানুর রহমান ও তানজিল আহমেদ গোলাম রুহানী।

তালিকায় সাবেক যেসব ওসির নাম আছে তাদের মধ্যে আছেন আমিনুল ইসলাম, শাহীনুর রহমান শাহীন, খন্দকার হেলাল উদ্দিন, মাহাবুব রহমান, ফরমান আলী, মাহফুজুল হক ভূঁইয়া, শিকদার মো. শামীম হোসেন, সেলিমুজ্জামান, মাজহারুল ইসলাম, পলয় কুমার সাহা, আতিকুর রহমান, মসিউর রহমান অন্যতম।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, আগস্টে যারা কাজে যোগদান করেনি তাদের বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কাজে ফেরার জন্য বলা হলেও অনেকে যোগদান করেনি। তবে সেই সংখ্যাটা বলতে চাননি কেউ। ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক হাজার।

তবে বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া বিভাগের এআইজি ইনামুল হক সাগর ঢাকা মেইলকে বলেন, বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য কাজে যোগদান করেছেন। তবে কতজন কাজে যোগদান করেনি সেই সংখ্যাট এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। যারা কাজে যোগদান করেনি সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এমআইকে