images

জাতীয়

সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ফেরা আমিরের চিকিৎসা চলছে বোনের বিয়ের টাকায়

আজিম বাপ্পি

১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:১২ পিএম

১৯ জুলাই—কফিশপের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন আমির হোসেন। আফতাবনগর পৌঁছানোর পর তিনি পুলিশ, ছাত্রলীগ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে মাঝে পড়ে যান। তখন ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ২টা বা আড়াইটা বাজছিল। চারপাশে শুরু হয় গুলির প্রচণ্ড শব্দ। মুহূর্তেই আফতাবনগর-বনশ্রী রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। জীবন বাঁচাতে ও নিজেকে লুকানোর চেষ্টায় আমির দৌড়ে গিয়ে একটি নির্মাণাধীন ভবনের চারতলার কর্ণিশের রড ধরে ঝুলে পড়েন। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি, কারণ পেছনে ছুটে আসা পুলিশ সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে একের পর এক গুলি করতে থাকে।

আমির হোসেন, যিনি সৌভাগ্যক্রমে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন, সম্প্রতি ঢাকা মেইলের প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেছেন। সেদিনের ভয়াবহ পরিস্থিতি শোনাতে গিয়ে আমির বললেন, “কাজ শেষে বাসার দিকে রওনা দিয়েছিলাম। মেরাদিয়ায় এসে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ি। দুই পাশ থেকে পুলিশ ও বিজিবির গাড়ি আসছিল। একসময় বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করে পুলিশ-বিজিবি ভবনটির চারতলায় উঠে যায়। পুলিশ সদস্যরা আমাকে দেখতে পেয়ে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে বারবার নিচে লাফ দিতে বলেন। একজন পুলিশ সদস্য আমাকে ভয় দেখাতে কয়েকটি গুলি করেন। তিনি চাইছিলেন আমি লাফিয়ে পড়ে মারা যাই। আমি নির্মাণাধীন ভবনটির রড ধরে ঝুলে থাকি।”

আমির বলেন, “প্রথমে উপরের দিক থেকে একজন পুলিশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়েছে। কিন্তু আমার গায়ে লাগেনি, কারণ তিনি চাননি আমি গুলিতে মারা যাই। এরপর আরেকজন পুলিশও চারতলা থেকে আমাকে গুলি করে, ভয় দেখিয়ে লাফ দিতে বলে। তার গুলিও আমার গায়ে লাগেনি। পরে তারা নেমে যায়।”

“এরপর তৃতীয় তলা থেকে একজন পুলিশ আমাকে লক্ষ্য করে ছয় রাউন্ড গুলি চালিয়েছে। সব গুলি আমার গায়ে লাগেছে। দুই পায়ে মোট ছয়টি গুলি করেছে পুলিশ। গুলিগুলো এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। তারপর ওই পুলিশ চলে যায়। আমি রড থেকে লাফ দিয়ে তৃতীয় তলায় চলে আসি। অনেক চিৎকার করে সাহায্য চাই। একজন পথচারী ফেমাস স্পেশালাইজড হাসপাতালে ফোন করেন। দুজন ডাক্তার এবং দুই পথচারী আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।”

আমির জানান, ফেমাস হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়, গুলির ক্ষতস্থানে সেলাই ও ব্যান্ডেজ করা হয়। তারপর হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি তিন দিন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন।

amir2
মেরাদিয়ার বাসায় ফুফুর সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ আমির হোসেন| ছবি: মাহমুদ বাপ্পি

আমিরের ভাষ্য, “বিল্ডিংয়ের ওপরের পুলিশ সদস্যরা চাইলে আমার মাথা বা বুকেও গুলি করতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি; তারা আমার আশপাশে গুলি ছুড়েছিল। তারা চেয়েছিল আমাকে নিচে ফেলে মেরে ফেলতে। গুলি করে মারতে চায়নি। কিন্তু তৃতীয় তলা থেকে যখন সরাসরি গুলি করা হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল আর বাঁচব না। পুরো শরীর অবস হয়ে আসছিল, এরপর একের পর এক গুলি ছুড়ছিল। সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা ব্যথায় ছটফট করেছি।”

সরেজমিনে দেখা যায়, আমিরের মা নেই। বাবা অন্যত্র বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। একটি আধা পাকা বাড়ির দুটি কক্ষ নিয়ে থাকেন আমির ও তার ভাই-বোন। আমির আফতাবনগরে একটি দোকানের কর্মী হিসেবে চাকরি করতেন। তার বড় ভাই নয়ন মিয়া পোশাক কারখানায় কাজ করেন। আমির ও তার ভাইয়ের আয়ে তিনজনের সংসার চলে। বোন সবার ছোট। তার নাম হাসনা (১৬)। তারা থাকেন ফুফুর সঙ্গে।

আমির জানান, এখন পর্যন্ত চিকিৎসা বাবদ অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে। তারা দুই ভাই কাজ করেন। সেই টাকায় সংসার চালিয়ে, ছোট বোনের বিয়ের জন্য কিছু টাকা সঞ্চয় করতেন। এখন চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে ছোট বোনের বিয়ের জন্য সঞ্চিত টাকাও খরচ হয়ে গেছে। তবে কিছু গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করায় এখন আর্থিকভাবে কিছুটা সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। তবে তাতেও খুব বেশি দূর এগোনো সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।

স্বাস্থ্যের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আমির বলেন, “জীবনে এতো বড় ও ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি হবো, স্বপ্নেও ভাবিনি। গুলি খেতে হবে, সেটা জীবনে কল্পনাও করতে পারিনি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আর খুব কষ্ট লাগে। সেদিনের ছয়টি গুলির মধ্যে একটি গুলি পায়ের তালু দিয়ে ঢুকে ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এভাবে ৫টি গুলিই মাংস ভেদ করে অন্য জায়গা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। একটি গুলি ভেতরে থেকে গিয়েছিল, সেটিই বেশি কষ্ট দিচ্ছে। এখন ওই অংশটা ফুলে রয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছেন পুরোপুরি সুস্থ হলেও, পায়ে বেশি শক্তি পাওয়া যাবে না। ভারী কোনো কাজও করা যাবে না।”

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলস্বরূপ স্বৈরাচারের পতন সম্পর্কে জানতে চাইলে ১৮ বছর বয়সী এই তরুণ বলেন, “তাদের পতনের খবর পেয়ে খুব ভালো লেগেছিল। কিন্তু সবার সঙ্গে আনন্দে শরিক হতে পারিনি। কারণ উঠে দাঁড়াতেই কষ্ট হয়। নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা সম্পর্কে আমিরের আশা, “আমার নিরীহ পরিবার। এই চিকিৎসা ব্যয় বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। নতুন সরকার যেন আমাকে কিছু সহযোগিতা করে। যেন আমি সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত চলতে পারি। সংসার খরচ, চিকিৎসা ব্যয়— সব মিলে চলাটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।”

amir-3
মেরাদিয়ার বাসায় ফুফুর সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ আমির হোসেন| ছবি: মাহমুদ বাপ্পি

তবে ছাত্রদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আমাকে দেখতে আসেনি। কিন্তু ছাত্রদের পক্ষ থেকে কয়েকবার দেখতে এসেছিল। তারা আমার চিকিৎসার জন্য সহযোগিতাও করেছে।” তবে এ ঘটনায় কোনো আইনি ব্যবস্থা নেবেন কিনা সে সম্পর্কে তিনি বলেন, “এ ঘটনায় কোনো মামলা করতে চাই না। মামলা করার মতো পরিস্থিতি আমার নেই। অল্প টাকা ইনকাম করি, তাতে সংসার চলা-ই কঠিন। মামলা চালাবো কীভাবে।”

বর্তমানে আমিরের অভিভাবক হিসেবে আছেন তার ফুফু মাহমুদা। ঢাকা মেইলকে তিনি জানান, “ভাইয়ের দুই ছেলে ও এক মেয়ে আমার কাছে থাকে। তাদের নিয়েই আমার সংসার। ভাইয়ের বড় ছেলে আর আমিরের আয় দিয়ে সংসার চলতো। সেই টাকা থেকে সংসার চালিয়ে কিছু কিছু টাকা তার বোনের বিয়ের জন্য রাখা হতো। ওই টাকা দিয়েই আমিরের চিকিৎসা চলছে। ওর চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত অনেক টাকা খরচ হয়েছে। কিছু কিছু মানুষ এসে সহযোগিতা করছে। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু সহযোগিতা পেলে আমিরের উন্নত চিকিৎসা করানো যেত।”

ঘটনাস্থল থেকে আমিরকে উদ্ধার করা নাসিং স্টাফদের একজন মো. ইনামুল হক বলেন, “সেদিন বিকেল ৪টায় আমাদের ইন্টারকমে ফোন আসে। জানানো হয় অনেকগুলো গুলি লেগেছে— এমন একজন পড়ে আছে। কিন্তু তখন চারদিকে এত পরিমাণ গোলাগুলি হচ্ছিল যে, তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। কিছুক্ষণ পর আরও দুই থেকে তিনবার ফোন এসেছিল। তখনও আমরা বের হতে পারিনি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আবার ফোন আসে। তখন বলা হয় ‘একটি লাশ পড়ে আছে’। পরে হাসপাতাল থেকে আমরা আর দুই তিনজন গিয়ে নির্মাণাধীন একটি ভবনের তৃতীয় তলা থেকে তাকে নামিয়ে আনি। তখন আমিরের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল, ভিপি অনেক কম ছিল। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তার ৬টি গুলি লেগেছিল। তার মধ্যে ৫টি বের হয়ে গেছে।”

ফেমাস স্পেশালাইজড হাসপাতালের এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিন ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন জানান, ১৯ জুলাই ছিল ভয়াবহ দিন। অন্য সবার মতো আমাদের স্টাফরাও আতঙ্কে ছিল। বিকেলে আমাদের কাছে ফোন আসে, জানানো হয় একটি ছেলে গুলি খেয়ে একটি ভবনের ছাদে পড়ে আছে। পরে আমাদের একজন ডাক্তার, দুজন নার্সিং স্টাফ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে সেখান থেকে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় উদ্ধার করে। হাসপাতালে আনার পর আমরা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেই। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই। 

উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় ১৬ জুলাই। সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই। কোটা সংস্কার, সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন এবং ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর এখন পর্যন্ত মোট ৬২৬ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।

এইউ