আজিম বাপ্পি
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:২৫ এএম
১৯ জুলাই, চরদিকে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। বারংবার কেঁপে উঠছিল মহাখালী রেলগেট এলাকা, কিছুক্ষণ পরপরই পুলিশ-ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ফাটছিল একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড। বিকেল ৪টায় মায়ের সঙ্গে বাইরে বের হয়েছিল জাহিদ হোসেন। একটু পরেই দৌড়ে চলে গেলেন বন্ধুদের কাছে। এরপর তাদের সঙ্গে নিয়ে পৌঁছালেন আন্দোলনের অগ্রসারিতে। অবস্থা বেগতিক দেখে বন্ধুরা পেছনে ফিরতে চাইলেন, কিন্তু ১৮ বছর বয়সী উদ্যমী বীর বন্ধুদের জানালেন, ‘তোরা যা গা, আমি শহীদ হমু’।
কথাটি বলেই আরও সামনে এগোলেন জাহিদ। চলে যান রেলগেট-সংলগ্ন মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে। ফ্লাইওভারের ওপর থেকে ছোড়া গুলি লাগে জাহিদের গায়ে। কিছুটা শক্তি নিয়ে তখনো আন্দোলনের ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু সেই অবস্থা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মাথায় গুলিবিদ্ধ জাহিদকে বেদম মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন পুলিশ সদস্যরা।
বন্ধুদের বরাত দিয়ে এই প্রতিবেদককে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা করছিলেন জাহিদের মা রাহেলা বেগম। সেদিনের পুরো ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে একে একে বর্ণনা করতে থাকেন তিনি। শহীদ জননী রাহেলা বলেন, পশ্চিম নাখালপাড়ার রেললাইনের পাশে চারতলার চিলেকোঠায় টিনশেডের একটি ঘরে থাকেন তার পরিবার। বাসাটির পূর্বদিকের জানালায় তাকালে দেখা যায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা। উত্তরের জানালায় দেখা মেলে মহাখালী রেলগেট। এই এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়া হয়, ১৮ জুলাই থেকে। সেদিনও নিজেকে সামলাতে পারেনি জাহিদ।
প্রথম দিন, অর্থাৎ ১৮ জুলাই-ই ছররা গুলিতে আক্রান্ত হন জাহিদ, কিন্তু বাসার কাউকেই বুঝতে দেয়নি। ১৯ জুলাই বেলা ১১টার দিকে মহাখালী রেলগেটে জড়ো হতে থাকে হাজারো বিক্ষোভকারী, যোগ দেয় জাহিদও। বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার খবরে ছেলেকে জোরপূর্বক ঘরে ফিরিয়ে আনেন বাবা জাহাঙ্গীর আলম। ঘরের দরজায় তালা দিয়ে রাখেন মা রাহেলা। দুপুরে খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ মায়ের পাশে শুয়ে ছিল জাহিদ, চুল আঁচড়ে দিতে বলেন চিরুনি দিয়ে।
দেখতে দেখতে বিকেল ৪টা বাজে। মহাখালীতে মুহুর্মুহু গোলাগুলি শুরু হলো। অনেকে দেখতে বের হচ্ছিল, সঙ্গে আমি আর জাহিদও গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি জাহিদ পাশে নেই। দৌড়ে চলে গেছে কয়েকশ গজ দূরে, অর্থাৎ মহাখালী রেলগেটে। তার বন্ধুরা জানাল, জাহিদ আন্দোলনে সবার আগে ছিল। তাদের বলেছিল— তোরা যা গা, আমি শহীদ হমু’।
কথাগুলো বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রাহেলা বেগম। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন পাশেই বসা ছিলেন, রাহাত হোসেন। তিনি জাহিদের বড় ভাই। মিরপুর বাঙলা কলেজ থেকে গত বছর এইচএসসি পাস করা এই তরুণ জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর জাহিদ উঠে দাঁড়ায়, চেষ্টা করছিল আন্দোলনে টিকে থাকার। কিন্তু তখন কয়েকজন এসে তাকে মারধর করতে থাকে। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশ সদস্যরা। মাথায় গুলিবিদ্ধ জাহিদ মরধরের পর মারা গেলে পুলিশের এক সদস্য পা দিয়ে জাহিদের শরীর উল্টেপাল্টে দেখেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তারা সেখান থেকে চলে যায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে রাহাত বলেন, জাহিদ নিজে আন্দোলনে অংশ নিলেও বড় ভাইকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করে বলেছিল, ‘তুমি থাক আব্বু আম্মুকে দেখতে।’
বিলাপ করতে করতে রাহেলা বেগম জানান, সন্ধ্যা ৬টার দিকে ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পান বাবা জাহাঙ্গীর। জাহিদের বন্ধুদের দেওয়া তথ্যমতে ছুটে যান হাসপাতালে। কিন্তু ছেলের লাশ পেতে, মুখোমুখি হতে হয় নানান বিপত্তির। লাশ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। এরপর আন্দোলনকারীরা গলিতে জাহিদের লাশ লুকিয়ে রাখেন। সন্ধ্যার পর নিয়ে যান শাহীনবাগ মসজিদে। কিন্তু ভয়ে সেখানে লাশ গোসল করায়নি কর্তৃপক্ষ। পরে জানাজার জন্য জাহিদকে আনা হয় ঘরের পাশের হাজী মরণ আলী মাদরাসা কমপ্লেক্সে। ওই দিন রাতে জাহিদকে স্থানীয় রহিম মেটাল কবরস্থানে দাফন করা হয়।
শহীদ জাহিদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের ইসলামপুর গ্রামে। তার মৃত্যুর পর সেখানে হানা দেয় ১২ থেকে ১৩ জন পুলিশ সদস্য। সৃষ্টি করে ভীতিকর পরিস্থিতির। রাহাত জানান, জাহিদের মৃত্যুর পর পুলিশ বিভিন্নভাবে হয়রানি করতে থাকে। জাহিদের বন্ধু রাকিব, মেহেদি, ইমনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। তাদের কাছে জানতে চায় রাহাত (আমি) কোথায় আছি।
এ ঘটনায় কোনো মামলা করেছেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে রাহেলা বলেন, ‘পুলিশ বিভিন্নভাবে হয়রানি শুরু করলে আমরা গ্রামে চলে যাই। সরকার পতনের পর ঢাকায় ফিরেছি।’ মামলার প্রশ্নে রাহেলার চোখে মুখে ছিল ভয়ের ছাপ। কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। পাশে বসা বড় ছেলে রাহাত মুখ খুলতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিয়ে রাহেলা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। এই এলাকায় থাকতে হবে। কারও সঙ্গে শত্রুতা করতে চাই না। আমার ছেলেকে শেখ হাসিনা, পুলিশ এবং সেদিন রাস্তায় থাকা ছাত্রলীগ মেরেছে। আমি তাদের বিচার চাই। যারা নির্দোষ, তাদের আসামি করে জাহিদের আত্মাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমার ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে, জান্নাতে আছে। সেখানে শান্তিতে থাকুক।’
জাহিদ নিহতের পর ছাত্র বা সরকার পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পেয়েছেন কি না— এমন প্রশ্নে দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন রাহেলা বেগম। চোখে মুখেও ছিল আক্ষেপের ছাপ। পাশে বসা রাহাত যেন ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকা রাহাত জবাব দিলেন, জাহিদ সিভিল এভিয়েশন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। তারপর পড়াশোনা বাদ দিয়ে ফুলের দোকানে কাজ করত। তাই হয়তো ছাত্রদের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি। আর সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো সহায়তা পাইনি। কিছুদিন আগে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এসেছিলেন। আমাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। এরপর ১ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছেন। অন্যকেউ আসেনি, খোঁজখবরও নেয়নি।
এইউ