images

জাতীয়

গ্রাফিতি, দেয়াল লিখন ও ২৪-এর বিপ্লব

মাহফুজ উল্লাহ হিমু

০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৪ পিএম

‘বিকল্প কে? আমি, তুমি, আমরা’ কিংবা ‘হামার বেটা মারলু ক্যানে’— খুব সহজ কিছু লাইন হলেও এগুলো ২৪-এর বিপ্লবের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছে। যা দীর্ঘ স্বৈরশাসনের ‘বিকল্প নেই’ বয়ান ও ভয়ের সংস্কৃতিকে দুমড়ে-মুচড়ে নতুন ভোরের সূচনা করেছে। ২৪-এর ছাত্র-জনাতার বিপ্লব একটি যুগান্তকারী ঘটনা, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তনের ঢেউ তোলে। এই বিপ্লবের পটভূমিতে গ্রাফিতি শিল্প এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। গ্রাফিতি ও দেয়াল জনগণের অনুভূতি, আকাঙ্ক্ষা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং প্রতিবাদের প্রতিফলন হিসেবে দেখা গিয়েছে।

বুলেট ও গ্রেফতার আতঙ্কের মধ্যে ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো’ ধরনের গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখনগুলো ছাত্র-জনতাকে রাজপথে নামার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। যার ফল স্বরূপ স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে। একই গ্রাফিতিগুলো বিপ্লবোত্তর চেতনার ধারক হিসেবে বীরদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ফলে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে দেশের আপামর ছাত্র-জনতা করেছে গ্রাফিতির বিপ্লব। দেয়ালে দেয়ালে মানুষের ক্ষোভ আর যন্ত্রণার গল্প ও নতুন দেশ গঠনের আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে গ্রাফিতিতে। বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ক্যালিগ্রাফিতে করা এসব গ্রাফিতি সড়কে এনেছে নান্দনিকতা।

গ্রাফিতির ইতিহাস ও বাংলাদেশ

গ্রাফিতি হচ্ছে দেয়াল বা যেকোনো উপরিতলে আঁকা এলোমেলো কোনো চিত্র। সাধারণ কোনো উক্তির সচিত্র প্রকাশ কিন্তু পেছনের বোধটা থাকবে খুব গভীর। সহজ ভাষায় এটাই গ্রাফিতি। গ্রাফিতির লম্বা ইতিহাস রয়েছে। প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের সময়কাল থেকে মূলত গ্রাফিতির প্রচলন ভালো করে শুরু হয়। সে সময় ওই দেশের অধিবাসীরা একে ভালোর চোখে দেখতো না। অনেকের মতে এগুলো পতিতালয়ের বিজ্ঞাপন জাতীয় কিছু নিদর্শন। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ছিল।

Graffiti_24--02

বাংলাদেশে দেয়াল লিখন প্রতিবাদের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল স্বাধীনতা উত্তর সময় থেকেই। তবে গ্রাফিতি খুব একটা আলোচিত বিষয় ছিল না। আরব বসন্তের পরপর ২০১৭ সালে আলোচনায় আসে ‘সুবোধ’। হঠাৎ রাজধানীর আগারগাঁও ও মিরপুরের কয়েকটি দেয়ালে ‘সুবোধ’-এর গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র মানুষের নজরে আসে। এই দেয়ালচিত্রগুলোর একমাত্র চরিত্র ছিল ‘সুবোধ’। এগুলোতে লেখা ছিল— ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে’, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই’, ‘সুবোধ এখন জেলে, পাপবোধ নিশ্চিন্তে বাস করছে মানুষের মনে’, ইত্যাদি। যা আরব বসন্তের প্রেক্ষাপটের আলোকে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে।

২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে গ্রাফিতি-দেয়াল লিখন

কোটা আন্দোলনকে ঘিরে গত জুলাইয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন জনতার আন্দোলনে রূপ পায় ১৮ জুলাই। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, ইন্টারনেট ব্লকআউট ও গণগ্রেফতারে স্তিমিত হয়ে যায় গণআন্দোলন। ঠিক সে সময় প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে উঠে আসে দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষ থেকে ২৯ জুলাই প্রথম সারাদেশে দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি কর্মসূচি দেওয়া হয়। স্কুল, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেয়াল লিখন আর গ্রাফিতির কাজ শুরু করে। নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে তারা এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। পুলিশ আতঙ্ক, স্বৈরাচারের দোসর ছাত্র সংগঠনের হামলা, হেলিকপ্টার থেকে গুলির শঙ্কা নিয়েই শিক্ষার্থীরা রঙ তুলি ও স্প্রে নিয়ে মাঠে নামে। যাদের আর্ট নিয়ে তেমন কোনো ধারণাই ছিল না, তারাও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ লিখেছে দেয়ালে দেয়ালে। সুযোগ ও হামলার আশঙ্কায় এর বেশিরভাই ছিল সাদামাটা আনাড়ি হাতের দেয়াল লিখন। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ডিজিটাল আর্ট। প্রফেশনাল গ্রাফিক ডিজাইনার ও কার্টুনিস্টরাও এতে অংশ নেন।

এসবের মধ্যে ছিল— ‘হামার বেটা মারলু ক্যানে?’, ‘ছাত্র যদি ভয় পাইতো বন্দুকের গুলি, উর্দু থাকতো রাষ্ট্রভাষা, উর্দু থাকতো বুলি’, ‘দেশ স্বাধীন হলে আমরা আবার ছাদে উঠব’, ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প’, ‘লোহার টুপি মানুষের মগজ খায়’, ‘মেধা শহীদ’, ‘আমি মেট্রোরেল হতে চেয়েছিলাম, খোদা আমাকে ছাত্র বানালো’, ‘বায়ান্ন দেখিনি চব্বিশ দেখেছি,’ ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে স্বৈরাচার’, ‘ভাই পানি লাগবে কারো, পানি?’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তের বিচার চাই,’ ‘আসছে ফাগুন আমরা দ্বিগুণ হবো’, ‘জেন-জি’, ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ ‘খুনি হাসিনার বিচার চাই’, ‘ছাত্র খুনি’ ইত্যাদি।

এছাড়া ছিল ‘চেটে নয়, খেটে বড় হও’, ‘নাটক কম কর পিও’র মতো শ্লেষাত্মক রাজনৈতিক গ্রাফিতিও।

Graffiti_24--03

সেসব দিনের স্মৃতি মনে করে রাজধানীর একটি বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়হানুল ইসলাম তুহিন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি এর আগে কখনও দেয়াল লিখন বা গ্রাফিতি করিনি। ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা ঠিক করলাম ২৯ জুলাই আমরা এতে অংশগ্রহণ করব। আমাদের মধ্যে কারোরই এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেই। তবে স্প্রে দিয়ে লেখার অভিজ্ঞতা অল্প কয়েকজনের ছিল। আমরা ব্যাগে স্প্রে নিয়ে ভোরে বের হয়েছি। হাঁটার পথে যখনই মানুষ কম দেখেছি, তখনই দ্রুততার সাথে শহীদ আবু সাঈদ ভাইয়ের বাবার উক্তি, মুগ্ধ ভাইয়ের শেষ কথা ‘পানি লাগবে কারো, পানি’ ও আমাদের ভাই হত্যার বিচারের কথা লিখেছি।

বিপ্লবোত্তর নতুন গ্রাফিতি ও বিতর্ক

তবে বিপ্লবের অগ্নিময় গ্রাফিতি আর দেয়াল লিখনগুলো গণঅভ্যুত্থানের এক সপ্তাহের মধ্যে মুছে ফেলা হয়। তার পরিবর্তে নতুন করে আঁকা হয়। যদিও এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। নেটিজেনদের একটা অংশ আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এর মাধ্যমে বিপ্লবের স্মৃতি ও চেতনা মুছে ফেলা হচ্ছে। তবে অপর অংশের দাবি ছিল, সে সময়ের বেশিরভাগ দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি ছিল অপরিকল্পিত। হামলার শঙ্কায় দ্রুত করা অনেক গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন ছিল অসুন্দর। সেগুলো মুছে পরিকল্পিতভাবে সেই লেখাগুলোই পুনরায় লেখা হয়েছে।

এরপর রাজধানী ঢাকার দেয়াল ও আইল্যান্ডগুলো ছেয়ে যায় নানা রঙের গ্রাফিতিতে। একই অবস্থা বিভাগীয়, জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে প্রফেশনাল শিল্পীরাও এতে অংশ নেন।

Graffiti_24--04

গ্রাফিতি অঙ্কনে অংশ নেওয়া তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আন্দোলনের সময় রাজপথে ছিলাম। শরীরে একাধিক রাবার বুলেট লেগেছে। এ বিপ্লবের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে তা মানুষের স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। এ লক্ষ্যে ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে গ্রাফিতি এঁকেছি। নিজেরা চাঁদা তুলে রঙ ও তুলি কিনেছি। আমাদের কেউই প্রফেশনাল না। যে যতটা পেরেছি এসব গ্রাফিতি এঁকেছি। এখানে কোয়ালিটির চেয়ে আমাদের অনুভূতি বেশি প্রকাশিত হয়েছে।

এমএইচ/