images

জাতীয়

মাকে লুকিয়ে আন্দোলনে যান মাহিম, বলেছিলেন আর মাত্র একদিন যাব

ঢাকা মেইল ডেস্ক

১৪ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৫২ পিএম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন আন্দোলনকারী কলেজ শিক্ষার্থী জিহাদ হাসান মাহিম (১৮)। একাদশ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী পড়তেন রাজধানীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে একদফায় রূপ নেয় তখনও যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছিল টানা সংঘাত-সহিংসতা। আন্দোলনে আর মাত্র একদিন যাবে জানিয়ে গত ৫ আগস্ট মাকে লুকিয়ে বের হয় মাহিম। কারণ, মাহিমের মা কোহিনুর বেগম ছেলেকে হারানো ভয়ে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেন। কোহিনুর বেগমের সেই শঙ্কাই সত্যি হলো, ঘরে ফিরে মাহিমের লাশ।

গত ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন জিহাদ হাসান মাহিম। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রাণ হারানো শিক্ষার্থী মাহিমের পরিবার শোকে স্তব্ধ।

মাহিমের মা কোহিনুর বেগম অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন, ‘সবাই বলছিল ৫ আগস্ট পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হবে। আগের দিন ছেলেকে বলি, তুই আন্দোলনে আর যাবি না। আমার খুব ভয় লাগছে। ছেলে বলল, আর এক দিনই যাব মা। সেদিন সকাল থেকেই ছেলেকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করছিলাম। সে বাসায় ছিল। আমাকে ডিম সেদ্ধ করতে বলল। কিন্তু আমি যেন বুঝতে না পারি সে বাইরে যাবে, এজন্য হয়তো এক ফাঁকে মোবাইল বাসায় রেখে এবং নাস্তা না খেয়েই বেরিয়ে যায়। দুপুরের পর থেকে বাড়ির সামনে রাস্তায় দলে দলে মানুষের আনন্দ-হৈহুল্লোড় টের পাই। আমার ছেলেটা মোবাইল ফোন বাসায় রেখে যাওয়ায় তার সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছিল না। আমি ভাবলাম, বন্ধুদের সঙ্গে সেও হয়তো আনন্দ-উল্লাসে মেতেছে। হয়তো কোথাও ঘোরাঘুরি করছে।’

নিহত এই শিক্ষার্থী বাবা মোহাম্মদ আলম মিয়া ছেলের শোক বয়ে বেড়ালেও ছেলের আত্মত্যাগে তিনি গর্বিত। মাহিমের বাবা বলেন, ‘গত ১৯ জুলাই আন্দোলনে গিয়ে সে ছররা গুলিতে আহত হয়েছিল। আমি তাকে বলি, আন্দোলনে গিয়ে তোর কিছু হলে আমাদের কী হবে? ছেলে উত্তর দিল, আমরা ঘরে বসে থাকলেই বা তোমাদের কী হবে! দেশটাকে পরিষ্কার করতে হবে। সেটা আমরা ঘরে বসে থাকলে হবে না। আমি বলি, তাহলে তুই একা যাবি না। আমি আর তোর ছোট ভাইও সঙ্গে যাব।’

মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘আমি স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী মানুষ। কষ্ট হলেও আমার সীমিত সামর্থ্যে ছেলের স্বপ্ন পূরণে চেষ্টা করে গেছি, নিজে স্বপ্ন দেখেছি। ছেলে হারিয়ে এখন আমার চারদিক অন্ধকার!’

জিহাদের বাবা জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে শুরু থেকেই জিহাদ সোচ্চার ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রত্যেক কর্মসূচিতে ছিল তার সরব অংশগ্রহণ। মৃত্যুর ২ দিন আগে তার ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে জিহাদ লিখেছিলেন, ‘গন্তব্য একটাই। হয় দেশের কাফনের কাপড় শেষ হবে, অথবা মিষ্টির দোকান খালি হবে।’

মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘আদর করে ছেলের নাম রেখেছিলাম জিহাদ। কে জানত ছেলে আমার বিপ্লবী হবে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রাণ দেবে! আন্দোলনে প্রাণ হারানো শিশু-কিশোরদের জন্য সবসময়ই দোয়া করেছি। আমার সন্তানও চলে যাবে ভাবিনি। আমাদের সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে এখন শুধু সুন্দর একটা দেশ চাই।’

মাহিমের নিহতের খবর ফেসবুক থেকে জানতে পারেন জানিয়ে তার ভগ্নীপতি তানভীর আহমেদ হিমু জানান, যাত্রাবাড়ী থানার কাছে গুলিবিদ্ধ জিহাদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান শান্ত, নোমান, মনিরসহ তরুণ বয়সের কয়েকজন। তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ায় ময়নাতদন্ত চাননি তারা। জিহাদের মরদেহ হাসপাতাল থেকে তারা নিয়ে যান দনিয়া জামে মসজিদে। তখনো তার পরিচয় অজ্ঞাত। পরে জিহাদের মরদেহের ছবি তুলে রাত ১০টার দিকে এক ফেসবুক পেজে পোস্ট দেওয়া হয়, কেউ চেনে কিনা। পরে একজন চিনতে পেরে কল দিয়ে জিহাদের পরিবারকে জানায় সেই পোস্টের ব্যাপারে।

ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করে মাহিমের বড় বোন রাজধানীর বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আফরিন বিনতে আলম মিম বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মনটা ছিল অনেক বড়। যেকোনোভাবে সমাজসেবা করতে চাইত সে। জিহাদ ছিল সদাচারী এবং অত্যন্ত মেধাবী। কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হয়ে জিহাদ বলেছিল, ভবিষ্যতে সে চাকরি করবে না, ব্যবসা করবে। অনেক কর্মসংস্থান করবে। বন্ধুদের কাছে সে বলত, আব্বুর বয়স হচ্ছে তাকে বেশিদিন চাকরি করতে দেব না। শিগগিরই আমার কিছু করতে হবে।’

জিহাদ হাসানের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার সুন্দলপুর ইউনিয়নে। সেখানে দাদার কবরের পাশে শায়িত করা হয়েছে তাকে। জিহাদকে নিয়ে গর্বিত পরিবারের সদস্যরা। তিন ভাই বোনের মধ্যে জিহাদ দ্বিতীয়। ছোট ভাই তাহমিম হাসান যাত্রাবাড়ী এলাকার বর্ণমালা আদর্শ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

এমএইচটি