মোস্তফা ইমরুল কায়েস
১৩ আগস্ট ২০২৪, ০৯:৫৭ পিএম
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে জুলাই মাস পুরোটা এবং আগস্টের প্রথম সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ও সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে গুলি করেছে পুলিশ। ঢাকাসহ সারাদেশেই আন্দোলন দমাতে চলেছে পুলিশি তাণ্ডব। খোদ পুলিশ সদস্যদের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠার পর সারাদেশে অতিরিক্ত বল প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের তালিকা করতে শুরু করেছে পুলিশ সদর দফতর। এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার তালিকা প্রস্তুত হয়েছে।
এই তালিকায় চিহ্নিতদের মধ্যে সাবেক একাধিক আইজিপি রয়েছেন। তারা নিয়োগে দুর্নীতি, অনিয়ম, গ্রেফতার বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আভাস পাওয়া গেছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলছে না পুলিশের কেউ।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া বিভাগের এসপি এনামুল হক সাগর ঢাকা মেইলকে বলেন, তিনি এমন বিষয়ে কিছু জানেন না। পরে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে পরামর্শ দেন।
এরপর বিষয়টি নিয়ে জানতে পুলিশ সদর দফতরের অপারেশন্স বিভাগের কর্মকর্তা ডিআইজি রেজাউল আলমের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তবে তাকে কল করেও পাওয়া সম্ভব হয়নি।
পুলিশের নতুন আইজি মো. ময়নুল ইসলাম বাহিনীকে শুদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পুলিশপ্রধান বলেন, সাম্প্রতিক বিক্ষোভে যেসব পুলিশ অপরাধ কাজের সাথে জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বিভাগীয় ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। পুলিশের লোগো ও ইউনিফর্ম পরিবর্তনের জন্য ইতোমধ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন থেকে পুলিশের প্রশিক্ষণের ওপর বেশি জোর দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন থেকে পুলিশে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত ছিলেন তারা বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এছাড়া নিচের পদের কর্মকর্তা যারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তারা এখন জাগ্রত হয়েছেন। দুর্নীতিবাজ ও দলকানা পুলিশ অফিসারদের চাকরিচ্যুত করার দাবি তুলছেন তারা। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি পুলিশে উচ্চাবিলাসী অপেশাদার অর্ধশতাধিক কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা বিগত সরকারের সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ‘অতিরিক্ত বল প্রয়োগ’ করেছেন বলে প্রমাণ রয়েছে। এদের অনেকে ছাত্র জনতার ওপর প্রাণঘাতী গুলিরও নির্দেশ দিয়েছেন। চিহ্নিত কর্মকর্তারা নিজেদের ‘বিশেষ আদর্শে’র পরিচয় দিতেন। পুলিশের নিজস্ব গোয়েন্দা কার্যক্রম ও বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে।
জনরোষের শিকার হওয়ার পর পুলিশ সদস্যরা কর্মবিরতি শুরু করেন। তখন তারা দুর্নীতিবাজ ও কোটা আন্দোলনে বল প্রয়োগ করে তাদের গুলি চালাতে বাধ্যকারী অফিসারদের শাস্তির বিষয়টি সামনে আনেন। তারা সাফ জানিয়ে দেন ওই কর্মকর্তাদের অধীনে আর কাজ করবেন না। এমনকি সাক্ষাৎ পেলে তাদের মারধর ও হামলার হুমকিও দেন। এই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে অতিরিক্ত এক পুলিশ সুপারকে নিচের পদের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা তোপের মুখে ফেলেন। একপর্যায়ে তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান। এরপর থেকে ক্ষোভ বাড়তে থাকে পুলিশে। প্রকাশ্যে তারা মুখ খুলতে থাকেন।
সম্প্রতি পুলিশের পক্ষ থেকে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনসহ ১১ দফা দাবি পেশ করা হয়েছে। সেই ১১ দফা দাবিতে দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের বরখাস্ত এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের দাবিও করেছেন আন্দোলনকারীরা। তাদের বেশির ভাগ দাবি ইতোমধ্যে মেনে নিয়েছে পুলিশের কর্তা ব্যক্তিরা।
আরও পড়ুন
পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের পেশাদারিত্ব ধ্বংসের জন্য বিশেষ একটি এলাকা ও রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তারাই দায়ী। তারা পুলিশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলোতে বসে পুলিশকে রাজনৈতিক দমন নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। পিআরবিসহ প্রচলিত যাবতীয় বিধি লঙ্ঘন করে তারা বিশেষ দলের হয়ে কাজ করেছেন। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
তালিকায় যাদের নাম রয়েছে
সূত্র জানিয়েছে, তালিকা তৈরির কাজ এখনো চলমান। প্রাথমিক তালিকায় কাদের নাম আছে সে সম্পর্কে জানা গেছে, প্রথমেই রয়েছে সদ্য সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাম। ১৯৮৯ সালে নিয়োগ পাওয়া অষ্টম ব্যাচের এই কর্মকর্তা আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর দুই দফায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। তার বিরুদ্ধে পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য ব্যবহারের সরাসরি অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে।
তালিকায় ১৯৯১ সালে নিয়োগ পাওয়া বিসিএস পুলিশ প্রশাসনের ১২তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে অতিরিক্ত আইজি কামরুল আহসান, আতিকুল ইসলাম ও পিবিআই প্রধান (সদ্য সাবেক) বনজ কুমার মজুমদারের নাম রয়েছে। এই বনজ কুমারের বিরুদ্ধে পুলিশে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রামের এসপি বাবুল আক্তারকে তার স্ত্রীকে হত্যার মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো এবং জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
১৯৯৫ সালে নিয়োগ পাওয়া বিসিএস পুলিশ প্রশাসনের ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন এসবির সদ্য ওএসডি হওয়া প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত আইজি ওয়াইএম বেলালুর রহমান, শিল্প পুলিশের প্রধান মাহবুবুর রহমান, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশীদ, সিআইডির সদস্য ওএসডি হওয়া প্রধান অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ আলী মিয়া, অতিরিক্ত আইজি দেব দাস ভট্টাচার্য্য, খন্দকার লুৎফুল কবীর, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় ও ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মীর রেজাউল আলম।
১৯৯৮ সালে নিয়োগ পাওয়া ১৭ ব্যাচের ডিএমপির ওএসডি হওয়া কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি অপারেশন আনোয়ার হোসেন, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার, ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন, রংপুর রেঞ্জের অব্যাহতি পাওয়া ডিআইজি আবুদল বাতেন, চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির ও সিআইডির শেখ নাজমুল আলম।
১৯৯৯ সালে নিয়োগ পাওয়া ১৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন কমিশনার মো. মাহবুবু আলম, রংপুর মেট্রোপলিটনের সাবেক কমিশনার ও চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মো. মনিরুজ্জামান, পুলিশ সদর দফতরের জয়দেব কুমার ভদ্র ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
২০০১ সালে নিয়োগ পাওয়া ২০ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন, শাহ মিজান শফিউর রহমান, মো. আনিসুর রহমান, মোল্যা নজরুল ইসলাম, এসএম মোস্তাক আহমেদ, জিহাদুল কবীর, মো. ইলিয়াস শরীফ, নূরে আলম মিনা, শাহ আবিদ হোসেন, মো. জামিল হাসান, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলাম, রাজশাহী রেঞ্জের বিপ্লব বিজয় তালুকদার, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বহুল আলোচিত মো. হারুন অর রশীদ ও এসবির মো. মনিরুজ্জামান।
২০০৩ সালে নিয়োগ পাওয়া ২১তম ব্যাচের ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, মো. মারুফ হোসেন সরদার, বিজয় বসাক, সুব্রত কুমার হালদার। একই সালে নিয়োগ পাওয়া ২২তম ব্যাচের ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার খন্দকার নূরুন্নবী, এস এম মেহেদী হাসান, একই ব্যাচের মোহাম্মদ জায়েদুল ইসলাম ও সঞ্জিত কুমার রায়।
২০০৫ সালে নিয়োগ পাওয়া ২৪ বাচের মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান, ডিবি উপকমিশনান মশিউর রহমান (সদস্য সিএমপিতে বদলি), নাবিদ কামাল শৈবাল, মো. শহিদুল্লাহ, সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, যশোরের পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ।
২০০৬ সালে নিয়োগ পাওয়া ২৫ ব্যাচের ঢাকার এসপি মো. আসাদুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জের এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল, পাবনার এসপি মো. আব্দুল আহাদ, ডিএমপির মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন, রাজিব আল মাসুদ ও মো. শাহ জাহান প্রমুখ।
এছাড়াও সাবেক আইজিপিদের মধ্যে জাবেদ পাটোয়ারী, বেনজীর আহমেদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, খন্দকার গোলাম ফারুক ও মো. শফিকুল ইসলামের নামও রয়েছে তালিকায়।
এমআইকে/জেবি