মোস্তফা ইমরুল কায়েস
০৭ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৫৯ পিএম
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে গত সোমবার (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং হেলিকপ্টারে করে ভারতের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করেন। এর পরপরই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ঢুকে পড়েন অসংখ্য মানুষ। গণভবনের ভেতরে যা ছিল তার সবই তারা নিয়ে যান।
শেখ হাসিনার যাবতীয় জিনিসপত্র ছাড়াও বাদ যায়নি তার পোষা বিড়াল, গরু, ছাগল, ফ্রিজের মাছ, পুকুরের হাঁস, আবাদকৃত সবজি, গাছের নারকেল, পেয়ারা, এসি, ফ্যান, প্রিন্টার, কম্পিউটার, চেয়ার, সোফা, টেবিল, এমনকি টিস্যু বক্সও।
সোমবার দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল প্রায় ছয়টা পর্যন্ত গণভবনে হাজার হাজার মানুষের লুটপাটের এসব দৃশ্য অবলোকন করেন এই প্রতিবেদক।
গণভবনের পূর্বদিকের দেয়াল ধরে তখন শত শত মানুষ ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছিল। তবে তার আগেই দুপুর দেড়টার দিকে গণভবনে প্রবেশ করে শত শত মানুষ। ইন্টারনেট সচল হলে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে নেট দুনিয়ায়। আর তখন শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষটা ছুটে আসতে শুরু করে গণভবনের দিকে।

বেলা ৩টা, গণভবনের দক্ষিণমুখী প্রধান গেটের সামনের সড়কে হাজার হাজার মানুষ। পূর্বমুখী রাস্তারও একই চিত্র। হাজার হাজার মানুষ। পা ফেলার মতো জায়গা নেই। এর মাঝে দেখা যাচ্ছে— চেয়ার, টেবিল, সোফা, প্রিন্টার, এলইডি টিভি, কম্পিউটারের মনিটর নিয়ে যে যার মতো ছুটছে। একটু এগোতেই দেখা গেল গণভবনের নিরপত্তা বেষ্টনির জন্য তৈরি করা লাল ইটের দেয়াল টপটে একজন উঠেছেন নারিকেল গাছে। সেই যুবক একটি নারিকেল মাটিতে ফেলতেই জনতার উল্লাস। অনেকে ভেবেছিলেন তিনি হয়তো আরেকটা নারকেল ফেলবেন। কিন্তু না, তিনি আরেকটি পেড়ে সেখানে বসেই খাওয়া শুরু করলেন। তখনো দেয়ালগুলো অক্ষত ছিল। সেই দেয়াল টপকে লোকজন লাইন ধরে ওঠে ভেতরে প্রবেশ করছে। কিন্তু বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে দেয়ালগুলোর মাঝ বরাবর ভেঙ্গে বের হওয়ার রাস্তা তৈরি করে জনগণ।
একজন বলছিল, গেট খুলে দিয়েছে ভাই। এ কথা কানে যেতেই লোকজন গেটের দিকে ছুটতে শুরু করলো। সবার মতো আমিও ছুটলাম সেদিকে। কিন্তু লোকজনের এত ভিড় ছিল যে দম বের হয়ে যাচ্ছিল। একেকবার একেকজন চাপ দিয়ে যেন নাড়ি-ভুড়ি সমান বের করে ফেলবে। প্রায় ১০ মিনিট ঠেলাঠেলির পর ভেতরে ঢুকতে পারলাম।
একটি সবজি ক্ষেতের মাঝে বিশাল মাঠ। তাতে শত শত মানুষ। সবজি ক্ষেতের পাশে কিছু লোক আখ তুলছে। আখের চারাগুলো তেমন বড়ও হয়নি। কিন্তু সবাই আখ গাছ ভেঙে নিয়ে নিজের মতো করে খাচ্ছে। কেউ পেয়ারা পাড়ছে, কেউ শিম ও বরবটি তুলছে। এক তরুণী হাতে দুটি বরবটি নিয়ে আরও খুঁজতে হয়রান হয়ে গেলেন। পরে বুঝতে পারলেন তিনি আসার আগেই সাবাড় করে দিয়েছে অন্যরা।
খানিকটা দূরে তিন নারীর জটলা। এক যুবকের হাতে খয়েরি রঙের বিড়াল। তাকে উদ্দেশ্য করে এক নারী বলছিল, বিড়ালটার খুব ভাগ্য ভালো, একজন মানুষের হাতে পড়েছে। সাথে সাথে যুবক বলে উঠলেন, ওর চোখ দেখছেন, কি আতঙ্ক চোখে মুখে!

ততক্ষণে গণভবনের সবজিক্ষেত, সামরিক কর্মীদের থাকার ব্যারাক ও শেখ হাসিনার যাবতীয় জিনিসপত্র সাবাড় করে যে যার মতো করে বাড়ির পানে ছুটছে। তাদের লুটপাট আর জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে মনে হলো এসব যেন গণিমতের মাল। কারও চোখে মুখে অপরাধ বোধের লেশমাত্র নেই।
লাউ শাক, শিম, মুলা যেমন নিয়ে যাচ্ছিল, তেমনি ফুল গাছ, টব, এমনকি গ্রোয়িং ব্যাগও নিয়ে যাচ্ছিল। গণভবনের ভেতরে থাকা লাল ও সোনালী রঙের চেয়ার, টেবিল ও সোফাগুলো নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি।
ফ্রিজে থাকা মাছ, মাংস ও রান্না করা খাবারও বাদ যায়নি। সেগুলো নিয়ে গণভবনের মাঠে বের হয়ে অনেকে উল্লাস করছিলেন। আর তরুণীদের কয়েকজন শেখ হাসিনার ঘর থেকে বের করে আনা শাড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিলেন। এর ফাঁকে ভিন্ন চিত্র চোখেও পড়েছে। দেখা গেল, কয়েকজন যুবক একটি শাড়ি নিয়ে ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে সেলফি ও ছবি তুলতে ব্যস্ত।
যারা তেমন কিছু পাননি তারা নিয়েছেন চালুনি, এগজস্ট ফ্যান, প্লেট, চামচ, লকার, লাইব্রেরিতে থাকা বই ও ম্যাগাজিন, স্টিলের মই, শোকেস, বড় বড় ট্রাঙ্ক।

একটু সামনে এগিয়ে শুনি— কয়েকজন খোঁজ করছিল কোথায় থাকতো শেখ হাসিনা। এক সময় চোখে পড়লো একটা লাল ভবনের মাথায় ওঠে বসে আছে আর উল্লাস করছে কিছু যুবক। বুঝলাম এটাই শেখ হাসিনার থাকার ভবন ছিল। সেদিকে এগোলাম। সেখানে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। ভবনের পূর্বে খালি জায়গায় সোফা ও চেয়ার ফেলে লোকজন আরাম করছে। ভবনটি তিনতলা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় উঠে কয়েকজন যুবক ছবি তুলছে। নিচে খালি জায়গায় রাখা জিনিসপত্রগুলো লোকজন নিয়ে যেতে শুরু করে। সেই ভবনেই ছিল শেখ হাসিনার ব্যবহৃত ফ্রিজ, সোফাসহ যাবতীয় জিনিস। এর মাঝে এক তরুণ ফ্রিজে একটি মাছ পেয়েছেন আর তা নিয়ে উল্লাস করতে করতে বের হচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে একজন গ্যাসের লাইনও খুলে ফেলে।
সেই ভবন থেকে বের হয়ে উত্তর পাশে গিয়ে দেখি সামরিক ব্যারাকে চলছে লুট। যা পাচ্ছে সব নিয়ে যাচ্ছে। সেনা সদস্যরা বাধা দিলেও কে শোনে কার কথা। এক যুবক প্রধানমন্ত্রী প্রধান প্রটোকল কর্মকর্তার পোশাক বের করে নিয়ে রীতিমতো গায়ে জড়ালেন। আর হিড়িক পড়ে গেল তার সাথে ছবি তোলার।
সেখান থেকে পূর্বদিকে এগিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। পুকুরে থাকা হাঁসগুলোকে ধরতে শুরু করলো কয়েকজন।
এরপর ফিরে এলাম শেখ হাসিনার থাকার ঘরের সামনে পশ্চিম পাশে। সেখানে কয়েকজন যুবক আগুন জ্বালিয়েছে। পাশেই ফাঁকা বিশাল মাঠে কয়েক হাজার মানুষ। এর মাঝে চোখে পড়লো শেখ হাসিনার থাকার ভবনের মাথায় ওঠে পতাকা নিয়ে উল্লাস করছে বিক্ষুদ্ধ জনতা। মাঠে ছিল আইসিটি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রাইভেটকার। সেটিতে চলল উল্লাস। এক পর্যায়ে সেটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর মাঝেই চলছে শত শত মানুষের সেলফি ও ছবি তোলার হিড়িক।

একজন বলছিল, স্বাধীনতার অমর স্বাদ পেলাম আজ। তাই স্মৃতিটাকে ফ্রেমে বন্দি করে রাখছি যাতে ভবিষ্যতে ছেলেকে বলতে পারি। এরইমধ্যে অনেকে মাঠে আসরের নামাজ জামাতে আদায় করছিল। দেরি না করে আবারও সবজি ক্ষেতে ফিরে এলাম। এবার দেখি আখ ক্ষেতের পাশে একটি লাল দুধেল গরু একটি বাঁশের খুঁটিতে বাধা। সেটি দেখতে জনতার ভিড়। তবে যিনি সেটি নিয়ে বসে আছেন জানালেন, তিনি গরুটি জবাই করে এতিমখানায় দেবেন। এরপর আখ ও পেপে ক্ষেত মাড়িয়ে দেয়ালের কাছে পৌঁছলাম। একটু এগোতেই দেখি কয়েকটি সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে জনতা। সেগুলো দিয়ে চলছে ঢোকা ও বের হওয়ার কাজ। সেখান থেকে সামনের সড়ক মাড়িয়ে মোহাম্মদপুর মাতৃসদন হাসপাতালের দিকে এগোতেই চোখে পড়লো রিকশায় করে এক যুবক বড় একটি কালো ফ্রিজ নিয়ে ছুটছে। আর তা দেখে লোকজন বলছিল, নিয়ে যাও ভাই, এসব তো আমাদেরই টাকাতেই কিনেছিল হাসিনা।
এদিকে পরদিন মঙ্গলবার গণভবনের মূল দরজা বন্ধ থাকলেও ভাঙা প্রাচীর টপকে ঢুকতে দেখা গেছে সাধারণ মানুষকে। এদিন দুপুরে গণভবন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ সরকারি বাসভবনের নিরাপত্তায় থাকা সুরক্ষা ব্যাটালিয়নের (এসপিবিএন) কোনো সদস্যই নেই। সে জায়গায় আছেন সাধারণ মানুষ। মূল গেইটের উত্তর দিকের দেয়ালের ভাঙা অংশ দিয়েই পায়ে হেঁটে গণভবনে প্রবেশ করছে হাজার হাজার মানুষ।
ফরহাদ হোসেন নামে একজন দর্শনার্থী ঢাকা মেইলকে বলেন, গণভবন তো কখনও ভেতরে গিয়ে দেখিনি। এখন সুযোগ পেলাম। তাই দেখতে এসেছি। অনেকেই এভাবে গণভবনের ভেতরের অংশ দেখতে আসছেন। পুরুষের পাশাপাশি দর্শনার্থীদের সারিতে দেখা গেছে নারী ও শিশুদেরও।

এমআইকে