মোস্তফা ইমরুল কায়েস
২৯ জুলাই ২০২৪, ০৮:৩১ এএম
বাবার স্বপ্ন ছিল তাকে বিদেশ পাঠাবেন। এজন্য পড়ালেখা বাদ দিয়ে বাবার কথামতো চিটাগাং রোড এলাকায় একটি সেলুনে কাজ শিখছিলেন ১৭ বছরের কিশোর রাকিব হোসেন। গত দুই বছর ধরে রাকিব সেখানে কাজ শেখে। গত ২০ জুলাই (শনিবার) রাকিব সেলুনে কাজ শেষ করে বের হন। উদ্দেশ্য ছিল নতুন জামা কেনার। পুলিশ ও কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আর নতুন জামা কেনা হয়নি। বুলেট তার পা কেড়ে নিয়েছে। রাকিবের ঠিকানা এখন হাসপাতাল।
আক্ষেপ করে রাকিবের বাবা কবির হোসেন ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, ছেলেটা জামা কিনতে বের হইছিল। কিন্তু পথেই গুলি লাগল।
রোববার (২৮ জুলাই) বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক এন্ড পুনর্বাসন কেন্দ্রের (যা পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত) ক্যাজুয়ালটি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন রাকিব। এ সময় রাকিব ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
গেল শনিবার যাত্রাবাড়ীর চিটাগাং রোড এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী এবং পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের সময় একটি বুলেট তার পা ভেদ করে চলে যায়। আহত হয়ে বেশ কিছুক্ষণ পড়েছিলেন রাস্তায়। এরপর তার কোনো এক সহকর্মী তাকে পড়ে থাকতে দেখে উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করেন। কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে তার ঠিকানা হয় পঙ্গু হাসপাতাল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। পায়ে গুলি লেগে রক্ত সঞ্চালন নালী ছিঁড়ে গিয়েছিল। ফলে তার সেই বাম পাটি সুস্থ করা সম্ভব হয়নি চিকিৎসকদের পক্ষে। অগত্যা সেটা কেটে ফেলতে হয়েছে। রাকিব এখন থেকে একটি পায়ের উপর ভর করে চলবেন। তবে আগামীর জীবন অনেকটাই তার অনিশ্চিত।
রাকিবের বয়সই বা কত হলো! পরিবারের জানায় ১৭ বছর। চেহারায় এখনও কিশোরের ছাপ। হাসপাতালের বেডে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে। রাকিবের ডান হাতে স্যালাইন ও ইনজেকশন দেওয়ার জন্য ক্যানুলা লাগা। ফলে সেই হাতে খেতে পারছিল না। তার পাশে মা দুপুরের খাওয়ার জন্য দুই পিস মুরগির মাংস আর ভাত মেখে তাকে খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত করছিলেন। এ সময় কথা হচ্ছিল রাকিবের বাবা কবির হোসেনের সাথে। পাশে ছিল রাকিবের চাচা-চাচী, ফুপু এবং খালারা। তারা তাকে দেখতে এসেছেন। তবে তাদের আদরের সন্তানের এমন পরিণতি তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। সবার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
এর ফাঁকে কথা হয় রাকিবের বাবার সাথে। রাকিবের বাবা কবির হোসেন জানালেন, তিনি তার দুই ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রাম রোড এলাকায় ভাড়া থাকেন। রাকিব তার বড় ছেলে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে সে। আর পড়াশোনা করেনি। গত দুই বছর থেকে রাকিব চিটাগাং রোড এলাকায় একটি সেলুনে কাজ শেখে। তবে ঘটনার দিন তিনি কোটা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য নয়, সেলুন থেকে বের হয়ে তার নতুন জামা কিনতে বের হয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল নিউ মার্কেটে যাবেন। কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। কিশোর হওয়ায় দেশের পরিস্থিতি তেমন বুঝে উঠতে পারেননি। সেলুন থেকে বের হওয়ার পর রাস্তায় পুলিশ শত শত লোকজনকে ধাওয়া দেওয়ার সময় ভিড়ের মধ্যে পড়ে যান। এর ফাঁকে একটি গুলি বিদ্যুতের খাম্বায় লেগে ফেরত এসে তার পায়ে আঘাত করে। তবে সেই গুলিটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নাকি অন্য কারো ছিল তা জানা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। কারণ ওই মুহূর্তে রাকিবের প্রাণ নিয়ে টানাটানি।
তিনি বলছিলেন, ‘রাকিব মার্কেট যাইবার লাইগা বের হয়েছিল। এ সময় মাইনষের মধ্যে পইড়া যায়। একটা গুলি খাম্বায় লাইগা ওর পায়ে আইসা লাগে। কিছুক্ষণ পর হের লগে কাজ করে এক পোলা। দোকান থেকেও হেরে দেইখা ছুটে গেছে। ওই পোলায় উদ্ধার কইরা আল বারাকা হাসপাতালে নিয়া গ্যাছে। এরপর ঢাকা মেডিকেল, এখান থাইকা হৃদরোগ হাসপাতাল। শ্যাষে পঙ্গুতি নিয়ে আইছে।’
রাকিবের পরিবার জানায়, রাকিবের পায়ের অবস্থা ভালো ছিল না। ফলে গত সোমবার তার সেই পা টিকে কেটে ফেলতে হয়েছে। গুলি লাগায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় তার পায়ে। এছাড়াও পায়ের রক্তনালীর রগ ছিঁড়ে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। এবং কালচে হয়ে গিয়েছিল রগগুলো। ফলে পঙ্গু হাসপাতালে দায়িত্ব থাকা হচ্ছে চিকিৎসকরা পা-টিকে শেষমেষ তারা সেটি কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন।
রাকিব তার পরিবারের বড় সন্তান। বাবা চিটাগাং রোডে মুদিখানার দোকান করেন। স্বপ্ন ছিল ছেলেকে সেলুনে কাজ শেখানোর পর বিদেশ পাঠাবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন নতুন জামা কিনতে বের হয়ে শেষ হয়ে গেল।
এ সময় রাকিবের বাবার প্রশ্ন রাখেন, তার ছেলে কি স্বাভাবিকভাবেই হাঁটতে পারবে? সরকার কি তার ছেলেকে কৃত্রিম পা দেবে?
তিনিই পরে জানান, প্রধানমন্ত্রী পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিশেষ করে গুলিতে আহত ব্যক্তিদের দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি প্রতি আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। এছাড়াও যাদের পা কেটে ফেলা হয়েছে তাদেরকে আগামী তিন মাসের মধ্যে কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
এদিকে পঙ্গু হাসপাতালের (নিটোর) পরিচালক কাজী শামীম উজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আহত ১৭৬ জন চিকিৎসার জন্য এসেছিল। তাদের মধ্যে ১৪৫ জন গুলিতে আহত। এখন পর্যন্ত ৭৬ জন ভর্তি আছেন। তাদের বিশেষ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এমআইকে/এএস