নিজস্ব প্রতিবেদক
১১ জুলাই ২০২৪, ১২:০৭ পিএম
প্রশ্নফাঁস করার পর বসত নিয়োগ বোর্ড। বোর্ডে প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন সৈয়দ আবেদ আলী। তার নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত হতো কাকে কোন পদ দেওয়া হবে। টাকার অংকের ওপর নির্ভর করে প্রথম-দ্বিতীয়ও নির্ধারণ হতো পরীক্ষার্থীদের। প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের ‘শিরোমণি‘ পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে এই তথ্য জানা গেছে।
সিআইডিতে প্রশ্নফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন। তারা জানান, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে কারা কোন পদে চাকরি নিয়েছেন তাদের একটি তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ওই তালিকা পিএসপি এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে সিআইডি।
রিমান্ডে পিএসসির ডেসপাচ অফিসার খলিলুর রহমান জানান, তিনি ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় ১০ প্রার্থীর কাছে প্রশ্নফাঁস করেছেন। তাদের মধ্যে তিনজন বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করছেন। এছাড়াও সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও রেলের বিভিন্ন নিয়োগের প্রশ্নফাঁসে তার হাত ছিল। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি এসব কথা বলেন। আদালতে খলিল বলেন, প্রশ্ন পাওয়া পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছয়জন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর মধ্যে তিনজন মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়েন।
আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে প্রশ্নফাঁস করা, বিভিন্ন পদে চাকরি পাওয়া অনেকের নাম পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা সে অনুযায়ী তালিকাও প্রস্তুত করছে। এই চক্রে আরও যারা জড়িত, তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় সিআইডির মামলায় গত মঙ্গলবার পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ছয়জন দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ জুলাই বাংলাদেশ রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে গত সোমবার শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডের বাসা থেকে সৈয়দ আবেদ আলী এবং তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান ওরফে সিয়ামকে গ্রেফতার করে সিআইডি। একই অভিযোগে পিএসসির দুই উপ-পরিচালক, এক সহকারী পরিচালকসহ ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় সরকারি কর্মকমিশন আইনে মামলা করে সিআইডি।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, গাড়িচালক হলেও আবেদ আলী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিলাসী জীবনযাত্রা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। আবেদ আলী অন্তত ৫০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের মালিক। ঢাকায় তার একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি রয়েছে। গ্রামের বাড়িতে ডুপ্লেক্স বাড়ি ও বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি রয়েছে। আবেদ আলী আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে জানান, গত বছরের শেষের দিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ৩ হাজার ১০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের অনেকের কাছে ফাঁস করা প্রশ্ন বিক্রি করেছেন এবং তাদের চাকরিও হয়েছে।
এছাড়া সিআইডির হাতে গ্রেফতার হওয়া পিএসসির উপ-পরিচালক আবু জাফর এর আগেও বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। গোয়েন্দা তথ্যে পিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তার অপকর্মের বিষয়ে অবহিত করায় কয়েক দফা পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। উপ-পরিচালক জাফর ঢাকার মালিবাগে জ্যোতি কোচিং সেন্টার নামে একটি কোচিং সেন্টার চালান। এই কোচিং সেন্টারের আড়ালে প্রশ্নপত্র কেনাবেচার কাজ করতেন। আসামি সাখাওয়াত ও সাইমের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকরিপ্রার্থীদের সংগ্রহ করতেন তারা। আসামি সাজেদুল জিজ্ঞাসাবাদে জানান, মূলত উপ-পরিচালক জাফরের কাছ থেকে তিনি প্রশ্ন পেতেন।
এছাড়া পিএসসির সহকারী পরিচালক আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধেও অনেক আগ থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। মিরপুরে তার একটি কোচিং সেন্টার রয়েছে। পিএসসির ডেসপাচ (চিঠিপত্র আদান-প্রদান) শাখার কর্মচারী খলিলুর রহমান ৩৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ভুয়া প্রশ্নপত্র বিক্রি করেন। প্রশ্নপত্র বিক্রির সময় ২০১২ সালে হাতেনাতে গ্রেফতার হন তিনি। ২০১২ সালের ৭ অক্টোবর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হলেও তাতে বলা হয়, ‘অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি।’ পরে তাকে বিভাগীয় মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখন তার বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডির কর্মকর্তাদের বলেছেন, রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তিনি সংগ্রহ করেছেন উপ-পরিচালক আবু জাফরের কাছ থেকে। এ জন্য আবু জাফরকে তিনি দুই কোটি টাকা দেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরও বলেন, পিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কক্ষের ট্রাংক খুলে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন সংগ্রহ করে সেগুলো টাকার বিনিময়ে ফাঁস করতেন। এর মধ্যে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার (কোন বিসিএসের, সেটি জানা যায়নি) প্রশ্নপত্রও রয়েছে। এ কাজে পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী বিভিন্ন সময় তার সঙ্গে ছিলেন বলেও জানান।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সাবাইর ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের এসআই নিপ্পন চন্দ্র দাস জানান, গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতে জবানবন্দি দেওয়া আসামিরা হলেন— পিএসসির ডেসপাস রাইটার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম, মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল, সাখাওয়াত হোসেন, সাইম হোসেন ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিটন সরকার। আর কারাগারে পাঠানো ১০ আসামি হলেন— আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান, পিএসসির উপ-পরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির, সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মামুনুর রশিদ, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তাপ্রহরী শাহাদত হোসেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনিশিয়ান নিয়ামুল হাসান ও জাহিদুল ইসলাম।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এজহারনামীয় আসামিরা ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদে আরও কয়েকজন সন্দেহভাজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন— পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, পিএসসির শরিফুল ইসলাম ভূইয়া, দীপক বণিক, খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, এ কে এম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এ টি এম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম, কৌশিক দেবনাথসহ অনেকে। তারা সবাই আত্মগোপনে রয়েছেন। এসব আসামিসহ অন্তত ৬০ জন এই চক্রে জড়িত বলে জানিয়েছেন তিনি।
এইউ