নিজস্ব প্রতিবেদক
০৯ জুলাই ২০২৪, ০৪:০৫ পিএম
মাথায় সাদা টুপি। মুখে পাকা লম্বা দাড়ি। ৬৩ বছর বয়সী ভদ্রলোকের নাম আব্দুল মালেক। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তার কাজ কর্মকর্তার গাড়ি চালানো। তিনি গাড়ি চালাতেন ঠিক, তবে কর্মকর্তার জন্য নয়। নিজের জন্য, অর্থাৎ গাড়ি কর্মকর্তার হলেও ব্যবহার করতেন নিজের কাজে। বলছিলাম স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) আবুল কালাম আজাদের সেই গাড়ি চালকের কথা। যিনি সংস্থাটির গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পেলেও; প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ, বদলিসহ নানা অনিয়ম করে বনে যান শতকোটি টাকার মালিক। রাজধানীতে বিলাসবহুল বেশ কয়েকটি বাড়ি। নিজের নামে খামারসহ ব্যাংকে জমিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
মালেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। দেখতে সাদামাটা ভদ্রবেশী মনে হলেও; বাস্তবে তিনি ভয়ঙ্কর এক ব্যক্তি। অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা থেকে শুরু করে আছে জাল টাকার ব্যবসাও। অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্য, অর্থ আদায় সবই করেন। গাড়িচালক পেশার আড়ালে এমন কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড নেই যা তিনি করেন না। খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের গাড়িই রেখেছিলেন নিজের কব্জায়। অধিদফতরের নিয়োগ-বাণিজ্য থেকে শুরু করে ক্রয়, টেন্ডারবাজি ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। অধিদফতরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদেরও নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। শুধু তাই নয়, নিজ এলাকায় মালেক ছিলেন মূর্তিমান এক আতঙ্ক। অবৈধ অস্ত্র ও টাকার গরম দেখিয়ে তিনি ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। প্রকাশ্য অস্ত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে শক্তির মহড়া দিতেন। তার চক্রে ছিল একাধিক লোক। যাদের নেতৃত্ব দিতেন মালেক নিজেই। তাদের হুমকি-ধমকিতে এলাকার লোকজন তটস্থ থাকতো। ভয়ে কারো মুখ খোলার সাহস ছিল না। কেউ মুখ খুললে তাকে নানাভাবে হয়রানি করতেন। তার ওপর নেমে আসতো খড়গ। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে হয়েছেন টাকার কুমির।
বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট—সবই আছে তার। তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন, অবৈধ ব্যবসা, সম্পদ অর্জনের এসব অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। ২০২০ সালে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা মেলে সকল অভিযোগের। পরে একই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকার অদূরে তুরাগের এলাকার কামারপাড়া থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে। এ সময় তার কাছ থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন, ৫ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ টাকার জালনোট, ১টি ল্যাপটপ ও ১টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সাদামাটা ভদ্রলোক ছদ্মবেশী আরেকজনের কর্মকাণ্ড। তিনি সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী। গতকাল সোমবার (৮ জুলাই) গ্রেফতার হওয়া এই গাড়িচালকের ব্যাপারে ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১২ বছরে বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ রয়েছে তিনি এবং পিএসসির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
আব্দুল মালেকের মতো আবেদ আলীর গল্পও আরব্য রজনীর রূপকথার ‘আলাদীনের’ মতো। আলাদীন যেমন জাদুর চেরাগ পেয়ে শূন্য থেকে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি গাড়িচালকের চাকরি পেয়ে শূন্য থেকে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন আবেদ। গাড়িচালকের চাকরি আবেদ নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছেন তিনতলা বাড়ি, করেছেন একটি পাকা মসজিদ, বাগান ও খামার। কিনেছেন বহু ফসলি জমি। দামি বাড়ি, গাড়ি, প্লট-ফ্ল্যাট, এমনকি তৈরি করেছেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স কোম্পানিও।
এখন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেওয়া আবেদ আলীর এতকিছুর নেপথ্যে রয়েছে পিএসসির অধীনে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস। গাড়িচালক হয়ে পিএসসিতে ঢোকার পরই আবেদ আলী প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে যুক্ত হন। বছরের পর বছর ধরে বিসিএস পরীক্ষাসহ বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে কামিয়ে নেন শতকোটি টাকা। আর সেই টাকায় বিলাসী জীবনযাপনের পাশাপাশি গড়েছেন একের পর এক সম্পদ।
এদিকে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারদের মধ্যে রয়েছেন পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক (ডিসপাস) সাজেদুল ইসলাম।
এছাড়াও রয়েছেন, সাবেক সেনা সদস্য নোমান সিদ্দিকী, ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের রাজনীতি করা এবং বর্তমানে মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন ও বেকার যুবক লিটন সরকার।
অপর দিকে আবেদ আলীর দুর্নীতি সামনে আসার পর ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে বিষয়টি। সামাজিকমাধ্যমে হচ্ছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেকে মালেক ও আবেদ আলীর ঘটনাকে একই সূত্রে গাঁথা বলে মন্তব্যও করছেন। ফেসবুকের নিউজ ফিডজুড়ে এখন শুধুই আবেদ আলী। কেউ কেউ বলছেন, ‘আমাকে ড্রাইভার বানিয়ে দাও। আমি ড্রাইভার হতে চাই।’
ড্রাইভার মালেক-আবেদদের রাজকীয় হাল দেখে ঝড় উঠেছে নেট দুনিয়ায়। অনেকেই বলছেন, একজন ড্রাইভারের যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে ডিজি, সচিব, চেয়ারম্যানদের অবস্থা কী হবে?
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন— ড্রাইভার মালেক-আবেদ একদিনে এমন হয়েছে? না। সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ যেমন বেশি। ঠিক তেমনি অবস্থা মালেক-আবেদদের। ডিজি-চেয়ারম্যানদের তাপে তারাও উত্তপ্ত হয়েছে।
এইউ