জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
০৮ জুলাই ২০২৪, ১০:৪৭ পিএম
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় হঠাৎ করে আলোচনায় সরকারি কর্মকমিশনের একাধিক কর্মকর্তা ও সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী। পদের দিক থেকে নিচের সারির হলেও বড় কর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নফাঁসে যুক্ত থেকে আবেদ আলী বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। নিজ এলাকা মাদারীপুরের ডাসারে অনেকটা দানবীর হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছেন এই গাড়িচালক। হতে চেয়েছেন জনপ্রতিনিধিও। এসব কারণে সিআইডির হাতে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের ১৭ জন গ্রেফতার হলেও বেশি আলোচনা হচ্ছে আবেদ আলীকে নিয়ে।
শুধু নিজেই নন। আবেদ আলীর ছেলে ছাত্রলীগ নেতা (সদ্য অব্যাহতি পাওয়া) সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পুলিশের হাতে গ্রেফতার সিয়ামকেও একাধিক গাড়ি ব্যবহার করে এলাকায় অসহায় -দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অনেকটা 'মানবতার ফেরিওয়ালা'র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
এদিকে গাড়িচালকের চাকরি করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সৈয়দ আবেদ আলীর বিলাসী জীবনযাপনের ছাপ দেখা গেছে। নিজের ফেসবুকে রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ড, দান খয়রাত ও পরহেজগারির নানা তথ্য নিজেই দিয়েছেন।
অন্যদিকে ঢাকায় ও গ্রামে একাধিক বাড়ি, গরুর খামার ও সম্পদের তথ্য মিলেছে তারই ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নিজেকে রিয়েল প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানও দাবি করেছেন তিনি। যদিও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিত্তবৈভব বানিয়েছেন বলে দাবি আবেদ আলীর।
সবশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন আবেদ আলী। আবেদ আলী সমাজের বিত্তবান ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে নিয়মিত চলাফেরা করতেন। প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গেও উঠবস করতেন তিনি।
শুধু তাই নয়, রাতারাতি এই গাড়িচালক আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ পেয়ে বদলে ফেললেন নিজের জীবন। কুয়াকাটায় থ্রি স্টার হোটেল নির্মাণ করছেন বলে নিজেই জানিয়েছেন। ১৮ মে ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আমাদের নতুন হোটেটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম আজ। হোটেল সান মেরিনা, কুয়াকাটা।’
এদিকে মানবিক কাজ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কিছু মানুষের মতো আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম হওয়ার চেষ্টা করেছেন। সবশেষ কোরবানির ঈদে তিনি এক কেজি করে মাংস ১০০ জনকে দিয়েছেন। মাংস বন্টন করেছেন দামি গাড়িতে চড়ে। ঘুরে ঘুরে। এলাকার অসহায়, অসুস্থ মানুষের জন্যও আর্থিক সহযোগিতা করেছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিয়েছেন তার সবই নিজের ফেসবুকে আছে সিয়ামের।
একাধিক গাড়ি ব্যবহার করা সিয়াম পড়েছেন ভারতে। তারপর দেশের একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বাবা-ছেলের এমন ভাইরাল হওয়ার ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই বলছেন, সামান্য গাড়ি চালক হয়ে এত সম্পদ কীভাবে করলেন তা খুঁজে বের করতে হবে। একসঙ্গে আরও বড় চক্র জড়িত কি না তাও খুঁজে বের করার কথা বলছেন কেউ কেউ।
যেভাবে আলোচনায় আবেদ আলী চক্র
গত ১২ বছরে বিসিএসসহ নন-ক্যাডার নিয়োগের অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে পিএসসির ১২ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। রোববার (৭ জুলাই) বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল-২৪ এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
গণমাধ্যমটির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত রেলওয়ের ৫১৬টি পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিসিএসের প্রশ্নফাঁস চক্রে পিএসসির অন্তত ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। এর মধ্যে বিভিন্ন ইউনিটের উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক, চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক, সাবেক সচিবের পিএসও রয়েছেন।
বিসিএসের প্রশ্নফাঁস চক্রের মূলহোতা পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম গণমাধ্যমটিকে জানান, ‘পিএসসি’র উপ-পরিচালক আবু জাফরের মাধ্যমে দুই কোটি টাকার বিনিময়ে রেলওয়ের প্রশ্ন ফাঁস হয়। পিএসসির একজন সদস্যের অফিসে সংরক্ষিত ট্রাঙ্ক থেকে আবু জাফর রেলওয়ের প্রশ্ন আমাকে বের করে দিয়েছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, আমি এটাও জানি ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস করা হয়।
বিসিএসের প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কমিশনের ক্ষমতাবলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠতে পারে। সেটি প্রমাণ হতে হবে। প্রমাণ হলে, কমিশন যদি মনে করে তাহলে প্রশ্নফাঁস হওয়া বিসিএসের কার্যক্রম বাতিলও হতে পারে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক ইমরান এ বিষয়ে নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, দীর্ঘ অনুসন্ধানে বিপিএসসিকেন্দ্রিক এই চক্রটিকে চিহ্নিত করেছি আমরা, যারা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিসিএসের প্রিলি, রিটেন, ভাইভাসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএসও বাদ যায়নি এদের খপ্পর থেকে। একটি দুটি তো নয়, ৩৩তম বিসিএস থেকে প্রায় ৩০টি ক্যাডার-ননক্যাডার পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পেয়েছি আমরা।
যে ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি
এদিকে দেশজুড়ে তোলপাড় হওয়ার একদিন পরই চক্রকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। সোমবার (৮ জুলাই) রাতে তাদের গ্রেফতারের কথা জানানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক (ডিসপাস) সাজেদুল ইসলাম, সাবেক সেনা সদস্য নোমান সিদ্দিকী, ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের রাজনীতি করা এবং বর্তমানে মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন ও বেকার যুবক লিটন সরকার।
এছাড়াও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী ও তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম।
এদিকে গ্রেফতারের পর সিয়ামকে ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
বিইউ/জেবি