images

জাতীয়

প্রতিদিন অর্ধ কোটি টাকার ইয়াবা-হেরোইন বিক্রি

কাজী রফিক

২২ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪৮ পিএম

মরণনেশা হেরোইনের এক পুরিয়ার দাম ২শ টাকা। এক পিস ইয়াবার দেড়শ থেকে ২শ টাকা। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে প্রতিদিন অন্তত ৫ হাজার পিস ইয়াবা ও ৩০ হাজারের বেশি পুরিয়া হেরোইন বিক্রি হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন অর্ধ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ইয়াবা-হেরোইন বিক্রি হয় এই ক্যাম্পে।

ঢাকা মেইলের মাসব্যাপী অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে। তথ্য সূত্র বলছে, মাদকের এই অভয়নগরে ২৪ ঘণ্টাই মেলে সব ধরনের মাদক। তবে কোন বিক্রেতার ঠিক কত টাকার মাদক বিক্রি হয়, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই কারও কাছেই। অবৈধ এই বাণিজ্যের লাগান টেনে ধরা যেমন যাচ্ছে না, একই সঙ্গে প্রতিদিন বাড়ছে মাদক বিক্রি।

জেনেভা ক্যাম্পের একাধিক সূত্র ও সংশ্লিষ্টদের মতে, অতীতের যেকোনো সময়ের চাইতে বর্তমানে সর্বোচ্চ পরিমাণ মাদক বিক্রি হচ্ছে উর্দুভাষীদের এই আবাসস্থলে।

পাঁচ শতাধিক মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাদক বিক্রির তথ্য মিলেছে ভুঁইয়া সোহেল সিন্ডিকেট থেকে। হেরোইন বিক্রেতা সোহেলের মাদক বিক্রির দুটি ‘পিক টাইম’ আছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ১২টা এবং সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টা তার এই সিন্ডিকেট থেকে হেরোইন কিনতে হুমায়ূন রোডে লাইন ধরেন মাদকসেবীরা। সেই দীর্ঘ লাইন সামাল দিতে আবার লোক নিয়োগ করেন মাদক বিক্রেতারা। এক বেলায় হাজারের বেশি মানুষের কাছে মাদক বিক্রি করে ভুঁইয়া সোহেল সিন্ডিকেট।

দিন ও রাত মিলিয়ে সোহেলের সরবরাহ করা মাদক বিক্রিতে কাজ করেন শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী। যাদের বেশিরভাগই হাজিরাভিত্তিক। একই সঙ্গে বিক্রির উপর ‘কমিশন’ পান মাদক বিক্রেতারা।

ক্যাম্পে অবস্থান না করলেও ‘চুয়া সেলিমে’র ইশারায় নিয়ন্ত্রিত হয় জেনেভা ক্যাম্পের অনেক কিছুই। কারণ একাধিক মামলার এই আসামি একাধারে ইয়াবা ও হেরোইনের বড় ডিলার। তার নেতৃত্ব অনুসরণ করে ক্যাম্পে মাদক বিক্রি করেন ৩০-৪০ জন।

তবে ‘চুয়া সেলিমে’র চাইতে জনবলে এগিয়ে আছেন আরেক ব্যবসায়ী ইমতিয়াজ। মাথার ওপর একাধিক মাদক মামলা থাকলেও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সূত্র জানিয়েছে, ইমতিয়াজের পরিবারের প্রতিটি সদস্যই মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি এই ডিলারের মাদক বিক্রিতে কাজ করছেন ৬০-৭০ জন বিক্রেতা৷ যাদের প্রত্যেকেই দিনে হাজারের বেশি মাদকসেবীকে ইয়াবা ও হেরোইন সরবরাহ করেন।

Geneva_Camp_Drug---02--Inner

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে জেনেভা ক্যাম্পে মাদক আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে চতুর ডিলার হিসেবে ধরা হয় ‘সৈয়দপুরীয়া’ পরিবারকে। রংপুর বিভাগের সৈয়দপুরে থেকে আসা এই উর্দুভাষী জনগোষ্ঠির ত্রিশটির বেশি পরিবার আছে জেনেভা ক্যাম্পে। তাদের পরিবারের দেড়শতাধিক মানুষ মাদক কারবারে জড়িত। যারা প্রতিদিন ২০ হাজারের বেশি মানুষকে মাদক সরবরাহ করেন বলে জানা গেছে। তবে এই মাদকের পুরো অংশই ক্যাম্প থেকে বিক্রি করা হয় না। মুঠোফোনে অর্ডার আসলে মাদকসেবীদের জন্য ‘হোম ডেলিভারি’ সেবাও দিয়ে আসছে সৈয়দপুরীয়া পরিবার।

জেনেভা ক্যাম্পের মাদক বিক্রেতাদের মাদক বিক্রির জন্য নিজ নিজ এলাকা রয়েছে। যা মাদক বিক্রির ‘স্পট’ হিসেবে পরিচিত। ৯টি ব্লকে বিভক্ত ক্যাম্পটির একেকটি ব্লক একেক মাদক ব্যবসায়ীর দখলে। কোনো কোনো ব্যবসায়ীদের দখলে আছে দুই থেকে চারটি পর্যন্ত ব্লক।

এই জায়গা ভাগাভাগি নিয়ে প্রায়ই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন মাদক ব্যবসায়ীরা। ক্যাম্প সূত্র জানিয়েছে, যেসব ব্লকে মাদকসেবীদের ভিড় বেশি দেখা যায়, সেসব ব্লককে কেন্দ্র করে প্রায়ই সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন মাদক কারবারিরা। গত ঈদুল ফিতরের চাঁদ রাতে একই কারণে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল জেনেভা ক্যাম্পের মাদক বিক্রেতাদের দুইটি অংশ।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এরইমধ্যে একাধিক দফা অভিযান পরিচালনা করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। ১০২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ২০০-২৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলাও করেছে পুলিশ। তবে তাতেও কিছু হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুল হক ভুঁইয়া ঢাকা মেইলকে জানান, জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে চারজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। বাকিদের ধরতে ও ক্যাম্পের পরিবেশ ঠিক রাখতে পুলিশ কাজ করছে বলে জানান তিনি।

এদিকে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জেনেভা ক্যাম্পের একজন বাসিন্দা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মাদক আগেও ছিল, কিন্তু এত ছিল না। আগে মাদক বিক্রি হতো ক্যাম্পের বাইরের দিকে। কয়েকটা স্পট ছিল। এখন পুরো ক্যাম্পটাই স্পট। এমন কোনো ব্লক নাই যেখানে আপনি মাদক পাবেন না। প্রতিটা ব্লকে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা পাওয়া যায়।’

অপর এক বাসিন্দা বলেন, ‘২০১৮-২০১৯ সালের চাইতেও এখন খারাপ অবস্থা। কিছু মাদক ব্যবসায়ীর জন্য সবাইকে বিপদের পড়তে হয়। আমরা তো ব্যবসা করি না। কিন্তু বাইরে কেউ বিহারি শুনলে আমাদেরকেও মাদক ব্যবসায়ী মনে করে। পুলিশ-র‍্যাব যখন অভিযান করে তখন সবাইকেই তুলে নিয়ে যায়। অনেকে বিনাদোষেও বিপদে পড়ে।’

পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে ক্যাম্পের মাদক পরিস্থিতিকে সমূলে উপড়ে ফেলার দাবি করেছেন ক্যাম্পের এই বাসিন্দা।

এদিকে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক সমস্যা সমাধান করতে চাইলে এক সপ্তাহের মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা করতে পারে বলে মনে করেন সমাজ সেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কে এম শহীদুজ্জামান। অধিদপ্তরের মোহাম্মদপুর শাখায় কর্মরত এই কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা একটা সিকিউরিটি ইস্যু। এখানে আমাদের তো আসলে সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা নাই। কিন্তু মাদক বিস্তারের অবস্থা ক্যাম্পে ভয়াবহ। বিষয়টা ওপেন হয়ে গেছে। যেখানে সেখানে মাদক বিক্রি হচ্ছে। রাস্তা-ঘাটে ওপেন হয়ে গেছে। মানুষ এতে করে মাদক গ্রহণ, মাদক ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। আমি মনে করি, এ বিষয়টাকে প্রাইম ইস্যু হিসেবে ধরা দরকার।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি ইচ্ছে করে সাতদিনও লাগার কথা না। আমার অফিস তো ক্যাম্পের পাশে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এটার বিষয়ে বিদ্রোহ আছে। কিন্তু মানুষ তো কিছু করতে পারে না ঐক্যবদ্ধভাবে।’

র‍্যাবের সদ্য সাবেক মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘আমাদের জেনেভা ক্যাম্প সংক্রান্ত টিম তাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তারা যখনই কোনো তথ্য পাবে মাদক চোরাচালান সংক্রান্ত অবশ্যই তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসবে।’

তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের তথ্য পেলে বড় মাদক ব্যবসায়ীরা পালিয়ে যায়।

জেনেভা ক্যাম্পের মাদক সমূলে উপরে ফেলতে র‍্যাব কোনো অভিযান করবে কিনা জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি পরিস্থিতি ওই রকম হয়, এ রকম তথ্য যদি আসে, জনপ্রতিনিধি-স্থানীয় সাধারণ মানুষ যদি চায় তাহলে কনসার্ন যারা আছেন, তারা অবশ্যই বিষয়টা দেখবেন।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, ‘জেনেভা ক্যাম্প-কেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন।’

ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘উন্নয়নের মূল স্রোত থেকে দূরে রেখে সমাজের স্বাভাবিক শৃঙ্খলা বজায় রাখাও সম্ভব নয়। জেনেভা ক্যাম্পের স্থানান্তর এবং মাদকের সাথে জড়িতদের আইনের মুখোমুখি করা এবং চলমান মাদক সিন্ডিকেট ভেঙে জেনেভা ক্যাম্প-কেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন।’

এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সামাজিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধ কার্যক্রম অপরিহার্য। অন্যথায় গোটা এলাকাকে কেন্দ্র করে মাদকের বাণিজ্য ও প্রসার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে যা সমাজের নানা স্তরে নেতিবাচক প্রভাব রাখবে।’

কারই