images

জাতীয়

জেনেভা ক্যাম্পে মাদকের ‘ফেরিওয়ালা’ পাঁচ শতাধিক

কাজী রফিক

২১ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪৯ পিএম

হেরোইনের নেশায় আসক্ত মো. হুমায়ুন (ছদ্মনাম)। পেশায় রিকশাচালক। দিনভর যাত্রী পরিবহনের বিনিময়ে যা উপার্জন হয় তা নিয়ে তার গন্তব্য রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। মরণনেশায় আসক্ত যুবক হুমায়ুন ঢাকা মেইলে জানান, তিনি হেরোইন কেনেন জেনেভা ক্যাম্প থেকে৷ প্রতি পুরিয়া ২০০ টাকা। শুধু হুমায়ুন নন, নেশাগ্রস্তদের নির্ভয় গন্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে উর্দুভাষী এই ক্যাম্পটি।

জেনেভা ক্যাম্প বা উর্দুভাষী বিহারী ক্যাম্পের উত্তর ও পূর্ব দিকে হুমায়ুন রোড, দক্ষিণে গজনবী রোড, পশ্চিমে শাহজাহান রোড। সময়ের সাথে সাথে এই ক্যাম্প হয়ে উঠেছে মাদকের উন্মুক্ত বাজার। সবার চোখের সামনেই মাদক বিক্রি হয় এখানে।

এই ক্যাম্পে জমজমাট মাদক ব্যবসার বিষয় পুরনো কিছু নয়। ২০১৮ সালের ১০ জুলাই নারায়ণগঞ্জে র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয় জেনেভা ক্যাম্পের মাদক শীর্ষ ব্যবসায়ী নাদিম হোসেন ওরফে পঁচিশ। সে সময় শীর্ষ আরেক মাদক ব্যবসায়ী ইশতিয়াক দেশে ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে করোনাকালে ভারতে মারা যান উর্দুভাষী এই মাদক ব্যবসায়ী।

সে বছর সাড়াশি অভিযানে শতাধিক মাদক কারবারিকে আটক করা হয় জেনেভা ক্যাম্প থেকে। ২০১৯ সালেও মাদক নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পটিতে বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সে সময় শতাধিক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এই দুই অভিযানে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক বাণিজ্য অনেকটা কমে আসে। তবে দুই বছরের মাথায় গজিয়ে ওঠে নতুন নতুন মাদক ব্যবসায়ী৷ ‘পঁচিশ’-ইশতিয়াকদের সময় যারা দৈনিক ৬০০-৭০০ টাকা হাজিরায় ইয়াবা বিক্রি করতেন, তারা বনে যান ব্যবসায়ী। ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন নিজ নিজ সাম্রাজ্য।

ঢাকা মেইলের মাসব্যাপী অনুসন্ধান

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে জেনেভা ক্যাম্পের বর্তমান শীর্ষ মাদক কারবারিদের নাম ও পরিচয়। বর্তমানে ক্যাম্পের মাদকের মূল গডফাদার চারজন। তারা হলেন— চুয়া সেলিম, ইমতিয়াজ, ভুইয়া সোহেল ও বম।

এরমধ্যে একাধিক মামলার আসামি ‘চুয়া সেলিম’ বর্তমানে পলাতক। তবে তার ইশারায় জেনেভা ক্যাম্পে চলছে ইয়াবা ও হেরোইন বিক্রি। তার নেতৃত্ব অনুসরণ করে ক্যাম্পে মাদক বিক্রি করেন ৩০-৩৫ জন।

Geneva_Camp_Drug---01--Inner--01

‘চুয়া সেলিমে’র চাইতে জনবলে এগিয়ে ইমতিয়াজ। তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যই মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এছাড়া তার আরও ৬০-৭০ জন বিক্রেতা রয়েছেন৷

হেরোইন ও ইয়াবার বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে ক্যাম্পের মুকুটহীন মাদক সম্রাট ভুঁইয়া সোহেল। শতাধিক মাদক বিক্রেতা আছে সোহেলের।

আরেক শীর্ষ ব্যবসায়ী মো. আফতাব৷ তবে তিনি ‘বম’ নামে পরিচিত। সৈয়দপুর থেকে জেনেভা ক্যাম্পে আসা পরিবারগুলোর মধ্যে একটি পরিবার তার৷ এ গোষ্ঠির সবাই মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত। তবে পরিবারের অন্যরা তার ধারে-কাছেও নেই।

এই চারজন শীর্ষ ব্যবসায়ীর ছায়াতলে আছেন আরও সাতজন মাঝারি পর্যায়ের মাদক কারবারি। তারা হলেন— পিস্তল নাঈম, পিচ্চি রাজা, লাল্লান (লালন), পার মনু, এস কে রাব্বানী, নওশাদ ও বাবু।

এর মধ্যে পিস্তল নাঈম জেনেভা ক্যাম্পের সাবেক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ইশতয়াকের বোন জামাই।

সেক্টর বা ব্লক-ভিত্তিক মাদক ব্যবসা

পুরো জেনেভা ক্যাম্পটি মোট ৯টি সেক্টর বা ব্লকে বিভক্ত। প্রতিটি সেক্টরে মাদকের ডিলার, বিক্রেতাও আলাদা।

‘এ’ ব্লকের মসজিদ গলি থেকে মোস্তাকিম চাপ পর্যন্ত, মোহাম্মদপুর মডেল কলেজের সামনে, জেনারেল হাসপাতাল রোড ‘চুয়া সেলিমে’র দখলে৷ ৩০ থেকে ৩৫ জন মাদক বিক্রেতার মাধ্যমে চলে তার ইয়াবা ও গাঁজা বাণিজ্য ৷ যদিও একাধিক মামলার আসামি সেলিম বর্তমানে পলাতক।

পাকিস্তানি পান দোকানের সামনে, মেন্টাল আসলামের চায়ের দোকানের সামনে ইয়াবা বিক্রি করেন নাঈম ওরফে পিস্তল নাঈমের লোকজন। মাদক গডফাদার ইশতিয়াক জেনেভা ক্যাম্প ছাড়ার পর তার জায়গা দখল করে তারই বোন জামাই নাঈম।

বাবুর ক্যাসেটের দোকান, জন্ডিস গলিতে ‘চুয়া সেলিমে’র ইয়াবা বিক্রি করেন ‘পিচ্চি রাজা’। তার বিক্রেতার সংখ্যা ১০-১২ জন।

ডি, ই, এইচ ব্লকে মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশ কয়েকজন। ডি ও ই ব্লকের জয়নাল হোটেল, বিউটির বাসার সামনে, আল বশির মসজিদের সামনে ও গজনবী রোডে ইয়াবা বিক্রি করেন ‘পার মনু’ ও ইমতিয়াজ। এর মধ্যে ইমতিয়াজ জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছটুর ছেলে।

এইচ ব্লকে ইয়াবা বিক্রি করা হয় লাল্লান (লালন), ইরফান ও শাহ আলমের নেতৃত্বে। এই তিনজন ডিলারের নেতৃত্বে ইয়াবা ও হেরোইন বিক্রি করেন শতাধিক বিক্রেতা।

জি ব্লকের আল ফালাহ হাসপাতালের সামনে, স্পোর্টিং ক্লাব, এসপিবিএন অফিস, বাবর রোড, নাদিম পোলাও দোকান, গোবর পট্টিতে বিক্রি হয় হেরোইন৷ সকাল ১০ থেকে ১২টা ও মাগরিবের নামাজের সময় দুই ঘণ্টা লাইন ধরে হেরোইন বিক্রি হয় জেনেভা ক্যাম্পের পূর্ব দিকে।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, হেরোইন কিনতে আসা মাদকসেবীদের লাইন নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা লোকবল আছে। লাইন ঠিক রাখতে মাথাপিছু তাদের দিতে হয় ২০ টাকা। একই সঙ্গে রিকশা নিয়ে আসা রিকশাচালকরা তাদের রিকশা রাখেন একটু দূরে। সেই রিকশা পাহারা দেওয়ার জন্য আছে আলাদা লোক। তাদেরকে রিকশাপ্রতি দিতে হয় ১০ টাকা।

একই এলাকায় হেরোইন বিক্রি করেন ভুঁইয়া সোহেলের ভাই রানা এবং রানার স্ত্রী শান্তা।

সি ব্লকে ভুঁইয়া সোহেলের হয়ে হেরোইন বিক্রি করেন নওশাদ, বাবু ও বম। তারা তিনজন আপন ভাই। জেনেভা ক্যাম্প তাদেরকে চেনে সৈয়দপুরীয়া নামে৷ ক্যাম্পের সুরভি স্কুল, মুরগী বাজার, পাইওনিয়ার হাউজিং ও সেক্টরের পার্সোনাল হাট (সেক্টরের কর্নারের ঘর) এলাকায় ইয়াবা ও হেরোইন বিক্রি হয় তাদের নেতৃত্বে।

সূত্র মতে, সৈয়দপুর থেকে আসা ৩০টি পরিবারের বসবাস এই এলাকায়। এ গোষ্ঠির বাসিন্দার সংখ্যা দেড়শ জনের বেশি। যার প্রায় সবাই মাদক বিক্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

এফ ব্লক মাঝারি পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ীদের দখলে। জেনেভা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান এস কে গোলাম জিলানীর ছেলে এস কে রাব্বানী এই ব্লকের সবচেয়ে বড় মাদক ব্যবসায়ী। তার অধীনে ইয়াবা ও হেরোইন বিক্রি করেন ৬০ থেকে ৭০ জন। ব্লকের জানু পান দোকানের সামনে তার মূল বিক্রি। একই ব্লকের আরেক ব্যবসায়ী নাসিম।

আই ব্লকের ইয়াবা ও হেরোইনের প্রভাব কম। ব্লকটিতে গাঁজার বিক্রি বেশি। যার নিয়ন্ত্রক রানী।

জেনেভা ক্যাম্প সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিন উর্দুভাষী এই ক্যাম্পটিতে মাদক হাতে খদ্দের খোঁজেন অন্তত পাঁচ শতাধিক মানুষ।

জেনেভা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান এস কে গোলাম জিলানীর কাছে ক্যাম্পের বর্তমান মাদক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে কথা বলতে রাজী হয়নি। এই প্রতিবেদককে জেনেভা ক্যাম্পে যেতে বলেন তিনি।

তবে পরে তিনি মোবাইল ফোন সেটটি এইচপিজিআরসির (স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশনস কমিটি) উপদেষ্টা ও জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট আইয়ূব আলীর কাছে দেন এবং তার সাথে কথা বলতে বলেন।

পরে অ্যাডভোকেট আইয়ূব আলীর কাছে জেনেভা ক্যাম্পের বর্তমান মাদক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটাকে শেল্টার দিচ্ছে স্বয়ং আমাদের প্রশাসন। আমাদের হাতের বাইরে চলে গেছে। এখানে প্রচুর টাকা। পুলিশরা আসে শুনি, প্রতি সপ্তাহে মোহাম্মদপুর থানা যেটা এখানে আছে দায়িত্ববান, সবাইকে তারা (মাদক ব্যবসায়ীরা) টাকা দিচ্ছে। প্রচুর পরিমাণে টাকা দিচ্ছে৷

মাদক ব্যবসায়ীদের পরিচয় ও ঠিকানা পুলিশের কাছে নিয়মিত দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান এই উর্দুভাষী সংগঠক৷

জেনেভা ক্যাম্পকে আপনারা মাদকমুক্ত করতে কাজ করছেন বলে দাবি করছেন, কিন্তু আপনাদের চেয়ারম্যান এস কে গোলাম জিলানীর ছেলে এস কে রাব্বানী নিজেই মাদক ব্যবসায়ী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট আইয়ূব আলী বলেন, ‘এটা ঠিক আছে। কিন্তু এখন সে এটাতে ইনভলভ নাই। একবার হয়ে গেলে অনেক কিছু ব্যাপার-স্যাপার থাকে৷ আপনি যার কথা বলতেছেন, উনি এখন ক্যাম্পে থাকে না। ক্যাম্পের বাইরে থাকে।’

এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুল হক ভুইয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এগুলো ভিত্তিহীন অভিযোগ। প্রশাসনের কে বা কারা নির্দিষ্টভাবে তথ্য দিতে বলেন। এভাবে ভিত্তিহীন কথা বললে তো সমস্যা।’

ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা নিয়ে জেনেভা ক্যাম্পভিত্তিক সংগঠন মহাজির রিহেবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট মুভমেন্ট (এমআরডিএম) সভাপতি ওয়াসি আলম বশির বলেন, ‘জিলানী হচ্ছে এইচপিসার্জির সহ-সভাপতি ও জেনেভা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান। তার ছেলেরা মাদক ব্যবসায়ী। ওই কমিটিতে আছে মাকসুদুর রানা ছটু, সে মাদক ব্যবসায়ী। এই কমিটির যারা আছে, তাদের অনেকেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের থেকে আমরা কি আশা করব?’

তিনি বলেন, ‘আমরা মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে ধরে পুলিশকে দিয়েছি। আমরা অনেক মামলার সাক্ষী হয়েছি। পরে আমাদেরকে থামানো হয়েছে। এই জিলানীরা আমাদেরকে থামিয়েছে।’

ওয়াসি আলম বশির আরও বলেন, ‘পুলিশ আসতেছে, মামলা দিতেছে, ধরতেছে। আমরা যেটা দেখতেছি, সেটা বলব।’ তিনি জানান, জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ এখন আর ক্যাম্পে থাকে না। তারা ক্যাম্পের বাইরে থেকে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে।

তবে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করেন মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভুইয়া। তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। নিয়ন্ত্রণেও আছে৷ এটাকে একেবারে নির্মূল করা কষ্টসাধ্য। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি।’

Geneva_Camp_Drug---01--Inner--02

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাদকের প্রসার যেভাবে বাড়ছে তা পুরো সমাজের অস্তিত্বের জন্যই হুমকিস্বরূপ। বিশেষ করে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে মাদক সেবন ও বিক্রির যে বাজার তা নিয়ন্ত্রণ করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। কারণ জেনেভা ক্যাম্পের সদস্য ও স্থানীয় পর্যায়ে পরিচিত কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতার মদদ ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মাদক বাণিজ্যের রমরমা প্রসার চলছে। কোনো ক্যাম্প বা শ্রেণির মানুষকে দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে প্রান্তিক অবস্থায় রেখে শৃংখল ও অপরাধমুক্ত জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়।’

কারই