ঢাকা মেইল ডেস্ক
০২ মার্চ ২০২৪, ১০:০৬ পিএম
আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পরপরই প্রশ্ন ওঠে যে আগুন নেভানোর জন্য সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কিনা। রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কজি কটেজ’ ভবনে বৃহস্পতিবারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন নিহত হওয়ার পরও এই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভবনটিতে আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থাই ছিল না।
খোদ বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, ঢাকা শহরের অন্তত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ এবং আগুন নেভানোর জন্য সেসব ভবনে কোনো প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।
এই অবস্থার মধ্যে সাধারণ নাগরিকরা কিভাবে বুঝবেন ভবনটি তাদের জন্য নিরাপদ কিনা?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগুন নেভানোর জন্য ‘পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা’গুলো কী কী বা প্রিয়জনদের নিয়ে কোনো ভবনে প্রবেশের আগে একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে বুঝবেন যে ভবনটি তাদের জন্য নিরাপদ কি-না— এই বিষয়গুলো সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। তাই খাওয়া-দাওয়া বা ঘোরাঘুরি কিংবা যেকোনো প্রয়োজনে কোনো ভবনে প্রবেশের আগে ওই ভবনটি কতটা নিরাপদ, তা যতটা সম্ভব যাচাই করে নেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
প্রকাশ্যে ‘সার্টিফিকেট’ প্রদর্শন
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, একটা ভবন নিরাপদ কিনা, সেটা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না। রাষ্ট্র এখানে সবচেয়ে বড় অপরাধ করছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু রাষ্ট্র এখনও শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারছে না যে রাষ্ট্রের সকল ভবন নিরাপদ, সেহেতু একটি ভবন যে নিরাপদ সেটার অনুমোদন প্রকাশ্যে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা জরুরি। এটিকে একটি উন্মুক্ত স্থানে সাধারণের জন্য প্রদর্শন করতে হবে।
অর্থাৎ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের আইন ও বিধিমালা মেনে যে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে এবং নির্মাণের পর সেখানকার সমস্ত কাজও যে আইন মেনেই হচ্ছে, সেই মর্মে একটা নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভবন মালিককে একটি সার্টিফিকেট তথা সনদ দেবে। সনদ প্রাপ্তির পর ভবন মালিক সেটিকে ফলক বা নোটিশ আকারে ভবনের সামনে টাঙ্গিয়ে রাখবে।
বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডকে ‘অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলনে, আমাদের এখানে একটা ভবন করা হলে ধরেই নেওয়া হয় যেসব সংস্থার অনুমোদন নিয়ে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ঘটনা ঘটার পর কর্তৃপক্ষ হাত গুটিয়ে বলছে যে আমার অনুমোদন নেয় নাই। কেউ বলছে, নিয়েছিল কিন্তু ব্যত্যয় করেছে।
‘সার্টিফিকেশন’ এর নিয়ম বিশ্বের সব দেশে আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই একটা নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন সার্টিফিকেশন দেয় এবং সেটা প্রকাশ্যে লাগিয়ে রাখতে হয় যে এই ভবনটি সমস্ত আইন কানুন মেনে পরিচালনা করা হয়েছে।
ইকবাল হাবি বলেন, সেই সার্টিফিকেট বা সনদে এটাও লেখা থাকবে যে ‘এটার সর্বশেষ অনুমোদন কত তারিখ হয়েছে এবং পরবর্তী অনুমোদন কত তারিখের মাঝে নিতে হবে’।
প্রবেশদ্বার তিন মিটারের কম না হওয়া
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, কোনো জনাকীর্ণ ভবনের প্রবেশদ্বার যদি তিন মিটারের কম হয়, তাহলে সেখানে প্রবেশ করার আগে ভাবা উচিৎ।
রেস্টুরেন্ট, মসজিদ, গির্জা, হাসপাতাল, স্কুল— এই ধরনের স্থানে একসাথে অনেক মানুষ প্রবেশ করে এবং বের হয়। এছাড়া বাণিজ্যিক ভবনে বিভিন্ন অফিস থাকায় সেসব স্থানও সবসময় লোকে লোকারণ্য থাকে। তাই এগুলোর 'প্রবেশদ্বার অবশ্যই তিন মিটারের চেয়ে কম হতে পারবে না’ বলে জানান তিনি।
পর্যাপ্ত সিঁড়ি ও অ্যালার্ম সিস্টেম
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক মেজর একেএম শাকিল নওয়াজ বলেন, আগুন লাগার পর একটা মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য ভবনে মূলত দুইটা জিনিস থাকা দরকার। পর্যাপ্ত সিঁড়ি এবং অ্যালার্ম সিস্টেম। আর কিছুর দরকার নাই।
তিনি বলেন, কোনো আবাসিক ভবন যদি ছয় তলার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আইন অনুযায়ী সেখানে চলাচলের জন্য দুটি সিঁড়ি থাকতে হবে। তবে যেগুলো বাণিজ্যিক ভবন বা কারখানা, সেখানে সিঁড়ি সংখ্যা আরও বেশি হবে।
মেজর শাকিল আরও বলেন, কমার্শিয়াল বিল্ডিং বা ফ্যাক্টরি যদি এক তলাও হয়, কিন্তু লোকসংখ্যা যদি দুই-তিনশ থাকে, তাহলে সেখানে ২৩ মিটার পরপর সিঁড়ি দিতে হবে।
তিনি বলেন, আগুন লাগার পর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার উপায় হলো ভবনে ফায়ার এবং স্মোক অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো। কারণ অ্যালার্ম সিস্টেম যদি কার্যকর থাকে, তাহলে কোথাও আগুন লাগার সাথে সাথে (ধোঁয়া হলেই) এটি তা চিহ্নিত করতে পারে এবং বিকট শব্দ করে।
জরুরি বহির্গমন পথ
একটি আদর্শ ভবনে দুই ধরনের সিঁড়ি থাকে। একটি দিয়ে সবসময় চলাচল করা হয়, অন্যটি দিয়ে জরুরি অবস্থায় আত্মরক্ষার জন্য বের হওয়া যায়। সেজন্য একে জরুরি বহির্গমন পথ বা অগ্নিনির্গমন পথও বলা হয়।
অগ্নিনির্গমন পথের বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, আবাসিক ভবন ছাড়া অন্য কিছু হলে সেই ভবনের প্রত্যেক তলায় অগ্নি নির্গমন পথ থাকতে হবে। তিনি বলেন, ভবনটি কাঁচঘেরা আবদ্ধ জায়গায় হলেও তার কোনো না কোনো ধরনের উন্মুক্ত ব্যবস্থাপনা (জরুরি বহির্গমন পথ) থাকতে হবে। ভবনে এই ব্যবস্থাপনা না থাকলে আমার সন্তানকে নিয়ে আমি সেখানে ঢুকবো না, যাবো না, অফিস করব না, খাবো না।
আগুন লাগলে ‘এক্সিট সাইন’ জ্বলা
কোনো ভবনে আগুন লাগলে (বিদ্যুৎ থাকুক বা না থাকুক) জরুরি বহির্গমনের দিকে যাওয়ার পথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলো জ্বলে ওঠার ব্যবস্থা থাকতে হবে বলে উল্লেখ করেন ইকবাল হাবিব।
তিনি বলেন, আগুন লাগলে ওই সময় জ্বলে উঠে, এমন এক্সিট সাইন এবং ডিরেকশন থাকতে হবে। সিনেমা হলে যেরকম এক্সিট এবং এন্ট্রি চিহ্ন থাকে, ঠিক সেরকম।
ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র
কোনো ভবনে আগুন লাগার পর সেটি ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা হলেও সময় লাগে। আগুন লাগার পর প্রথম দুই মিনিটকে বলা হয় প্লাটিনাম আওয়ার বা সবচেয়ে মূল্যবান সময়। এই সময়ে মাথা ঠান্ডা রেখে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করলে অনেকক্ষেত্রেই আগুন নিভিয়ে ফেলা যায় এবং আগুনকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় বলে জানান বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক মেজর একেএম শাকিল নওয়াজ।
তাই কোনো ভবনে প্রবেশের আগে সেই ভবনে ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আছে কিনা এবং থাকলে সেটি আদৌ কাজ করছে না, সেটি দেখে নিতে বলেন তিনি।
মিশ্র ব্যবহারের ভবনে না যাওয়া
একটি ভবনে যদি মানুষের বাসাবাড়ি, অফিস, এমনকি রেস্টুরেন্ট থাকে, তাহলে সেটিকে বহু কাজে ব্যবহৃত ভবন হিসেবে ধরা হয়। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলছেন, রাজউক ‘মিশ্র ব্যবহার’ নাম দিয়ে মানুষের সাথে এই অন্যায়টা করছে…এর জন্য রাজউক এককভাবে দায়ী।
রাজউক মিশ্র ব্যবহারের ব্যাখ্যা যথাযথভাবে করছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিশ্র ব্যবহার মানে হলো, অফিস এবং আবাসিক একসাথে থাকতে পারবে। কিন্তু রেস্টুরেন্ট থাকতে পারবে না। কারণ রেস্টুরেন্ট একটা বিশেষায়িত ব্যবহার।
তিনি বলেন, রেস্টুরেন্টের কিচেনকে (রান্নাঘর) বাণিজ্যিক কিচেন বলা হয়। এটির ডিজাইন করা অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল কাজ। এই যে এত এত রেস্টুরেন্ট বানানো হচ্ছে, সেগুলোর কিচেন নিয়মকানুন মেনে করা হচ্ছে না। কিন্তু সেটা দেখার জন্যও কেউ নাই।
ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোল সিল করা
উপরের বিষয়গুলো সাদা চোখে দেখে বুঝে নেওয়া যায় যে ভবনটি নিরাপদ কি-না। কিন্তু কিছু বিষয় আছে, যা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে পড়বে না। কিন্তু ভবনের নিরাপত্তার জন্য সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব) আলী আহমেদ খান বলেন, ভবনের ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোল সিল করা গুরুপূর্ণ। আধুনিক বহুতল ভবনগুলিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, হিটিং, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগের জন্য যে পাইপগুলো টানা হয়, সেগুলো যায় ডাক্ট লাইন এবং ক্যাবল হোলের ভেতর দিয়ে। এই লাইন ও গর্ত দিয়ে ধোঁয়া এবং আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ধোঁয়া এবং আগুন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, তাই ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোলগুলো আগুন প্রতিরোধক উপাদান দিয়ে ভাল করে বন্ধ করার কথা বলেন তিনি।
আলী আহমেদ খান আরও বলেন, আমরা সবসময় আগুন লাগার পরে কিভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সেটা বলি। কিন্তু আগুন লাগবেই না, আমাদেরকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেজন্য ভবন নির্মাণের সময়ই ইলেকট্রিক্যাল লাইনসহ অন্যান্য বিষয়গুলো মানতে হবে।
স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম
আগুন নেভানোর জন্য একটা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা হচ্ছে স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম। এটি একটি ভবনের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সাথে যুক্ত থাকে। কোনো স্থানের তাপমাত্রা ৫৭ ডিগ্রির বেশি হলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরিত হয়ে পানি ছিটিয়ে দেয়। ফলে আগুন নিভে যায়।
সাধারণত বড় বড় বাণিজ্যিক বা কারখানা ভবনে সাধারণত এগুলো ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে কিছু কিছু আবাসিক ভবনেও এগুলোর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
মেজর একেএম শাকিল নওয়াজ এ বিষয়ে বলেন, ভবনে আগুন লাগার পর মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য সেখানে সিঁড়ি এবং অ্যালার্ম সিস্টেম সবচেয়ে জরুরী। কিন্তু সম্পত্তি রক্ষার জন্য সেখানে পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। বা, স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম থাকা লাগবে।
ভবনের ডিজাইন ও উদ্দেশে পরিবর্তন
বেইলি রোডের যে ভবনে আগুন লাগে, শুরুতে সেটি একটি আবাসিক ভবন ছিল বলে জানান মেজর একেএম শাকিল নওয়াজ। তিনি বলেন, এই ভবনটা প্রাথমিকভাবে আবাসিক ভবন ছিলো। কিন্তু পরে এর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন চেঞ্জ করলে রাজউক, আবাসিক ভবনে রেস্টুরেন্টকে ব্যবসা করার লাইসেন্স দিলে সিটি কর্পোরেশন, সামনের দিকে কাঁচ বসালে সেই ইঞ্জিনিয়ার; এরা এই ঘটনার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে।
তিনি বলেন, কোনো ভবনে গ্লাস দিতে হলে সেটার ড্রয়িং এবং ডিজাইন পরিবর্তন করতে হবে…স্মোক এলে যেন তা অটোমেটিক্যালি বের হতে যেতে পারে। এই ভবনের ঐ গ্লাসের জন্য ভেতরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। ধোঁয়া ভেতরে ঢুকে গেছে, আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। এখানে কোনও ভেন্টিলেশন ছিলো না।
এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ভবন বানানোর পর তার উদ্দেশ্য পরিবর্তন করাটা গর্হিত অপরাধ। কারণ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের নকশা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা একদমই আলাদা।