images

জাতীয়

মানুষের মাঝে বেড়েছে রেস্টুরেন্ট আতঙ্ক

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

০২ মার্চ ২০২৪, ১০:০০ পিএম

লিলি পারভীন থাকেন ঢাকার মতিঝিল এলাকায়। সন্তানদের মাঝে মাঝে মুখরোচক ও ভালো কিছু খেতে পাঠান রেস্টুরেন্টে। কিন্তু এখন তার চিন্তা বদলে গেছে। সন্তান ও পরিজনকে আর কখনোই ঢাকা শহরের কোনো রেস্টুরেন্টে পাঠাবেন না তিনি।

লিলি কাজ করেন একটি বিদেশি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। শনিবার দুপুরে কাজের ফাঁকে এসেছিলেন বেইলি রোডে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পুড়ে যাওয়া ছয়তলা ভবন দাঁড়িয়ে দেখছিলেন তিনি। সাথে তার এক নারী সহকর্মী। এসময় তার সাথে কথা হচ্ছিল এই প্রতিবেদকের।

তিনি বলছিলেন, আমার ছেলেমেয়েরা বলছিল মা আমরা আর কখনোই রেস্টুরেন্টে খেতে যাব না। যা খাব ঘরে বানিয়ে খাব। ঘরেই মরব, তবুও বাইরের খাবার খাব না।

লিলির সহকর্মী আয়েশা আক্তার বলছিলেন, অবশ্যই আমাদের এখন ভাবতে হবে। এভাবে আর কতদিন। আমরা এভাবে আর পুড়ে মরতে চাই না। ঘরেই মরব তাও ভালো। কিন্তু খেতে গিয়ে মরব এটা কি ভাবা যায়! একটা মানুষ ভাল কিছু খেতে আসলো, কিছুক্ষণ পর তার শোনা গেল সে আগুনে পুড়ে মরেছে এসব কি মেনে নেয়ার মতো বলেন?

শুধু লিলি ও আয়েশা নয়, তাদের মতো অন্যদেরও রেস্টুরেন্ট ভীতি বেড়েছে বেইলি রোডের আগুনের ঘটনায়। কেউ প্রকাশে বলছে, কেউ না বলে চুপ করে আছে। জনমনে এই ভীতির প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে রেস্টুরেন্টগুলোতে। পরদিন রাজধানীতে দুইদিন দুটি রেস্টুরেন্টে আগুনের ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মানুষজনকে। যারা নিয়মিত  রেস্টুরেন্ট বা হোটেলে খাবার খেতে যান তারা এখন বাইরে খেতে যাবেন কিনা তা ভাবছেন।

res3

এমন কথাই বলছিলেন নাজমুল ইসলাম। সাত বছরের ছোট মেয়েকে নিয়ে শনিবার দুপুরের দিকে বেইলি রোডে এসেছিলেন তিনিও। অন্যদের সাথে পোড়া ভবনের বিপরীত পাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন এবং মেয়েকে আঙ্গুল ইশারা করে দেখাচ্ছিলেন এই সেই ভবন। যেটির আগুনে পুড়ে মরেছে ৪৬টি তরতাজা প্রাণ। আরও দগ্ধ হয়েছে অনেকে।

নাজমুল বলেন, এই তো পাশেই থাকি। কয়েকটি বিল্ডিং পরেই আমার বাসা। ঘটনার দিন আসিনি। আজ আসলাম মেয়েকে দেখাতে। এই ঘটনার পর আসলে ভাববার সময় এসেছে আমরা রেস্টুরেন্টে আর খেতে যাব কিনা। কারণ এই শহরে তো প্রতিদিন কমবেশি আগুনের ঘটনা ঘটছে। আর না ভাবলেও হতো যদি এক একটি ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যরা সচেতন হতো। তাতো হচ্ছে না! আর ঢাকার হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতে কোন ফায়ার এক্সিট পয়েন্ট বা আগুন লাগলে দ্রুত নামার কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই। এই কারণে আর রেস্টুরেন্টে খেতে যাব না ভেবেছি। দরকার হলে বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে বানিয়ে খাব।

নাজমুলের মতোই অন্যরাও ভাবতে শুরু করেছে। বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট প্রিয়দের মাঝে বেইলি রোডের ঘটনা আতঙ্ক ও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। তবে হোটেল বা রেস্টুরেন্টগুলোর মালিকদের সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন অনেকে। এই আগুনের পর অনেকেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না বলেও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

সায়েমা আক্তার এসেছিলেন বাসাবো থেকে। তিনি সেই ভবনের বিপরীত পাশের মার্কেটে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানে কোচিং করেন। তিনি বলছিলেন, আমরা যাদেরকে এগুলোর নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছে তারাই যদি তা সঠিকভাবে পালন না করে তাহলে তো হোটেল রেস্টুরেন্টে আর খেতে যাওয়া যাবে না।    

পোড়া ভবনের নিচে দুপুরে (শনিবার) দায়িত্বপালনকারী এসআই আশিক বলেন, আমরা সকাল থেকে কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেইনি। কারণ ক্রাইমসিনের আলামত নষ্ট হতে পারে।

res2

অন্যদিকে, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খ.ম মহিদ উদ্দিন।

আপাতত ভবনটির সামনের অংশ হলুদ ফিতায় ঘিরে রাখা হয়েছে। অনেককে প্রবেশ করতে চাইছে কিন্তু তাদের বাধা দিয়ে প্রতিহত করা হচ্ছে। পুলিশ সদস্যরা সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন। অনেকেই সেখানে যাচ্ছেন, উৎসুক জনতার আদলে দেখছেন, ছবি তুলছেন। তবে এখানে ইউটিউবারদের উৎপাত ছিল চোখে পড়ার মতো। 

পোড়া ভবনের পাশের ভবনে কাজ করেন আসলাম উদ্দিন। তিনি বলছিলেন, আমরা তো এই রেস্টুরেন্টে খেতে আসতাম। এখন অন্য কোথাও আর খেতে যাব কিনা ভাবছি। এমন হলে তো বাইরে খাওয়া মানুষ ছেড়ে দেবে। মানুষের নিরাপত্তাই যদি না থাকে তাহলে সেখানে যাবে কেন?

হোটেল ও রেস্টুরেন্টে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. মহিদ উদ্দিন বলেছেন, শুধু ব্যবসার কথা চিন্তা করবেন না। জীবনের নিরাপত্তার কথা আগে চিন্তা করবেন। বাইরের দেশগুলোতে দেখেছেন জরুরি বের হওয়ার রাস্তা রাখে।

তিনি আরও বলেন, যারা এ ঘটনায় যারা দায়ী তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। সেজন্য আমরা যেন সেফটি ফাস্ট বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা যেন আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট সেফটি ফাস্ট পরিচালনা করি।

বৃহস্পতিবার ৯টা ৫০ মিনিটের আগে বেইলি রোডের ছয়তলা ভবনটির নিচতলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে অন্য তলায়। মুহূর্তেই দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে আগুন। অন্যদিকে দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ তলায় থাকা রেস্টুরেন্টগুলোতে খেতে মানুষেরা আটকা পড়ে যান। অনেকে বাঁচার জন্য লাফ দেন কিন্তু অধিকাংশ মানুষই আটকা পড়েন। পরে ফায়ার সার্ভিস খবর পেয়ে ছুটে যায় এবং বিভিন্ন তলা থেকে ১৫ জনকে বিশেষ কায়দায় উদ্ধার করে। আগুন নেভানোর পর বিভিন্ন তলা থেকে ৪৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এখনো অনেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন। এ ঘটনায় শনিবার পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়েছে বলে জানানো হয়। এখন পর্যন্ত ৪৪টি মরদেহের পরিচয় মেলায় সেগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে ঢামেক। এখনো দুটি বাকী আছে।

এমআইকে/এমএইচটি