images

জাতীয়

বাংলা ভাষার বিকৃতি: যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:১৮ পিএম

প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষা বিকৃত হচ্ছে। কখনো মুখে, কখনো লেখায়, আবার কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই বিকৃতি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

ভাষার বিকৃতি হচ্ছে কখনো অদ্ভূদ শব্দের ব্যবহারে, কখনো আসল শব্দকে সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টার মধ্যদিয়ে।

ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষা নিয়ে যত আলোচনা। বাকি মাসগুলোতে বিষয়টি আলোচনাতেও থাকে না। প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষা বিকৃত হচ্ছে। কিন্তু এই বিকৃতি রোধে কতটুকু সংশ্লিষ্টরা কতটুকু কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছেন, সে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

প্রযুক্তির সাথে সাথে ভাষার বদলানোকে কেউ ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। আবার কেউ বলছেন এই বিকৃতি অব্যাহত থাকলে ভাষাই বদলে যাবে। আগামী প্রজন্ম ভাষার শেকড় থেকে দূরে সরে যাবে। ভাষা হারাবে তার স্বকীয়তা। নিজস্বতা।

ভাষার পরিবর্তনকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র যশোরের সাঈদ হাফেজ। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলেই ‘ভাষা বিকৃতি হচ্ছে, বদলে যাচ্ছে’ এসব অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি তাকে খুবই ব্যথিত করে। ভাষা বিকৃত হচ্ছে তা তিনি বলতে চান না। বরং তাতে নিত্যনতুন শব্দ যুক্ত হচ্ছে।

তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, একটি নির্দিষ্ট মাসে ভাষার প্রতি মানুষের ভালবাসা, অতিরিক্ত আহ্লাদ, দরদ উথলে ওঠে। এই জিনিসটাই আমার কাছে অশ্লীল মনে হয়। ভাষা তো কোনো বিশেষ সময়ে বিশেষ ঋতুতে চর্চার বিষয় না।

ভাষার প্রতি আমাদের এই দরদ, ভালবাসা যেন বারো মাসই বহাল থাকে। তাহলেই ভাষার প্রতি সুবিচার করা হবে বলেও মনে করেন এই তরুণ।

২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘ভাষা দূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শীর্ষক একটি লেখা প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি বলেছিলেন, ভাষার মাসে বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক চর্চা আমাদের ভাবায়। শুদ্ধবাদীরা শঙ্কিত হন, বাংলা ভাষা তার রূপ হারিয়ে কোনো শংকর ভাষায় রূপ নেয়, তা ভেবে।

অন্যদিকে ভাষা দূষণ ও বিকৃতি রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও একটি কমিটি গঠন করেছিল। পরে কমিটি ৯ দফা সুপারিশ করলেও সেগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। 

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও কবিতা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহ আলম। তার মতে, ভাষা তো পরিবর্তন হচ্ছে। সাথে ভাষার শব্দও বিকৃত হচ্ছে। এ বিকৃতি কখনো হচ্ছে মুখে, কখনো নাটক বা সংলাপে। তবে বেশিরভাগই হচ্ছে লেখা ও বলায়।

অধ্যাপক শাহ আলম বলেন, ভাষা বহুভাবে বিকৃত হচ্ছে। ভাষার যে গতি তা থেকে তাকে বিচ্যুত করে নতুন নতুন শব্দের নামে অপব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু মানুষ বাংলা ভাষার অলংকার ছেড়ে নিজেরাই একটা বলয় তৈরির চেষ্টা করে৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি ভাষা চর্চায় আমাদের নানা দুঃচিন্তায় ফেলে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিকাশ ঘটায় মানুষের ভাব প্রকাশের জায়গা বেড়েছে। আগের চেয়ে এখন মানুষ বেশি কথা বলে। এই কথা বলতে গিয়ে কতটুকু সঠিক বা শুদ্ধ বলছে তা হয়তো খেয়াল করে না। তবে শুদ্ধ বলার চর্চাটা পরিবার থেকে শুরু হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, একটি শিশু ছোটকাল থেকে যদি বাংলা না শেখে তবে শুদ্ধ কিভাবে বলবে। শিশু ইংরেজি বলার সময় ভুল করলে তা শোধরাতে বাবা-মা ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওই সন্তান যখন আবার বাংলা বলতে গিয়ে ভুল করছে তখন তারা কিছু বলছে না। এছাড়া পরীক্ষা পদ্ধতিতেও ভুল আছে বলে মনে করেন তিনি। কারণ মৌখিক পরীক্ষার সময় পরীক্ষা থেকে বলা হয় না যে আপনি শুদ্ধ করে কথা বলেন।

অধ্যাপক শাহ আলম বলেন, বাংলা ভাষাকে যেভাবে শ্রদ্ধা ও সম্মান করা দরকার সেটা আমরা করতে পারছি না। কারণ বাংলা শিখতে কোথায় যেন আমাদের একটা অনীহা ও অশ্রদ্ধা আছে। মর্যাদার একটা প্রশ্ন মনে হয় দাঁড় করিয়ে দিয়েছি আমরা। যেন ইংরেজি মাধ্যমে না পড়লে মর্যাদা থাকবে না। মনে হয় যেন ওই সন্তানটি বর্তমান যুগের ধ্যান-ধারণা থেকে পিছিয়ে এবং যুগের সাথে শামিল হতে পারবে না।

তবে আঞ্চলিকতায় কোনো দোষ দেখেন না তিনি। দোষ মনে করেন যখন ভাষাকে বিকৃত করে বলা হয়। অনেক ছেলেমেয়ে বাংলা, ইংরেজি ও  হিন্দির মিশ্রণে কথা বলার চেষ্টা করে। শুধু তাই নয়, নাটক সিনেমা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যারা উপস্থাপনা করেন তারাও শুদ্ধভাবে বাংলা বলার চেষ্টা করেন না। নাটকের সংলাপগুলোকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে কোনো অঞ্চলের ভাষাকে তুলে ধরতে চাইলেও সেটা পারছে না। আঞ্চলিক ভাষার ডায়লগগুলোকে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করে সেটাকেও বিকৃত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন রেডিওতে বিশেষ করে যারা জকি হিসেবে কাজ করে তারা বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে কথা বলার ফলেও ভাষার বিকৃতি হচ্ছে। আমরা আঞ্চলিকতাকে গ্রহণ করতে চাই কিন্তু বিকৃতি নয়। অনেকে ব্যঙ্গ করে নতুন শব্দ তৈরির করতে গিয়ে শব্দটি বিকৃত করে ফেলে, সেটা তারা বোঝে না। যার কারণে শব্দের অর্থও বিকৃতি ঘটে।

উত্তরণের পথ কি

কারমাইকেল কলেজের সাবেক এই শিক্ষক মনে করেন এজন্য অভিভাবক, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনেরও দায় আছে। তারাও এর দায় থেকে মুক্তি পেতে পারে না। শুদ্ধ উচ্চারণের মানসিকতাই বদলাতে পারে ভাষার বিকৃতি।

তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক মনে করেন, অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা ভাষা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও নিজস্বতা থাকার কারণে সামাজিক মাধ্যমে মানুষ যে যার মতো বাংলা ভাষাকে উপস্থাপন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার ও প্রক্রিয়া চালুর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যে পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল শুরু থেকেই সেটির ঘাটতি ছিল এবং সেই সিদ্ধান্তে যথেষ্ট ঘাটতি এখনো আছে।

তিনি মনে করেন, উত্তরণের ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমে যারা অরুচিকর বা নোংরাভাবে বা সংস্কৃতি বহির্ভূতভাবে ব্যবহার করবে বিকৃতি ঘটাতে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

দিনাজপুর সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস সহকারী অধ্যাপক শরীফুল ইসলাম মনে করেন, ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও ভাষার যথাযথ প্রয়োগ কিংবা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এর প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হলেই বিকৃতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

এমআইকে