মাহফুজ উল্লাহ হিমু
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১:২১ পিএম
বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারির হাত ধরেই এসেছে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালির স্বাধীনতা। ইতিহাসবিদদের ভাষায়, বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারির হাত ধরেই একাত্তর।
ভাষা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ‘আমতলা’। আমতলা তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ ছিল, যা বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) জরুরি বিভাগের গেট সংলগ্ন স্থানে অবস্থিত। পঞ্চাশের শেষ ভাগ এবং ষাটের দশকের প্রতিটি ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই আমতলা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই আমতলা থেকে পাকিস্তানি সামরিক শাসকের জারি করা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে প্রথম মিছিল বের হয়। ওই মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। এতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিকসহ আরও অনেকে শহীদ হন। তাদের আত্মদানে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায় বাংলা। যা আমাদের আলাদা সত্তার প্রতীক হয়ে দখলদার পাকিস্তান থেকে মুক্তিলাভের অনুপ্রেরণা জোগায়।
ভাষা আন্দোলনসহ ঐতিহাসিক নানা ঘটনায় তাৎপর্যপূর্ণ হলেও যত্ন-অবহেলায় ম্লান হচ্ছে এই স্থানের ইতিহাস। প্রতিদিন ঢামেক হাসপাতালে আসা হাজার হাজার মানুষের কাছে এটি একটি বন্ধ গেট ছাড়া কিছুই না। ‘ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমতলার ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণ থেকে...’ শিরোনামে একটি ফলক ছাড়া এই স্থানটিকে চেনার অন্য কোনো উপায় নেই। হকারদের হাক-ডাক, পণ্য কেনাবেচা এবং বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক পোস্টারে আমতলা প্রাঙ্গণের অস্তিত্বই হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি আসলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আলোচনায় আসা ছাড়া রাষ্ট্রীয় আয়োজনসহ কোথাও নেই আমতলার অস্তিত্ব।
আমতলার বর্তমান অবস্থা
সরেজমিন ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণটিতে দেখা যায়, দেয়ালে আবদ্ধ আমতলা প্রাঙ্গণের গেট দুই পাশে বন্ধ। একটি গেট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পাশে, অপরটি বাইরের প্রান্তে। ঢামেক প্রান্তের গেট তালাবদ্ধ থাকলেও মূল সড়কের ওপর থাকা গেটটি খোলা। কয়েকজনকে ভেতরে আসা-যাওয়া করতেও দেখা যায়। সড়কের পাশের গেটে কোনো পোস্টার না থাকলেও অপর গেটটিতে রাজনৈতিক ও বিভিন্ন সংগঠনের পোস্টার লাগানো রয়েছে।
বাইরের গেটটি হাসপাতালে আসা রোগীদের খাবার দোকান ও হকারদের দখলে। গেটের সামনের অল্প স্থান ছেড়ে পুরোটা জুড়েই চলছে রোগীদের প্রয়োজনীয় পণ্যের কেনা-বেচা। গেটের সামনের অংশে স্টোভ জ্বালিয়ে চলছে পুরি-সিঙাড়া ও চায়ের দোকান। খাবারের পাশাপাশি হাসপাতালের রোগীদের ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র বিক্রিও চলছে। হাড়ি-পাতিল, থালা-গ্লাস, প্লাস্টিকের বালতি, মগ, টুল, চেয়ার, বালিশ-চাঁদর-মাদুর-মশারি, জুতা, প্রসাধনী দ্রব্য, ফল, পান-সিগারেট, চা, ফিরনি, স্যুপ, ঝালমুড়ি, ভাতের হোটেল— সবই আছে এখানে। এতসবের ভিড়ে গেটের দিকে তাকানোর মতো সময়ই কারো নেই। অথবা তাকালেও ফলকে কি লেখা বা এখানে স্থাপনাটিই বা কিসের তা ভাবার সময়-সুযোগ কোনোটাই কারো নেই।
হাসপাতালে আসা এক ব্যাক্তিকে খাবার কিনতে দেখে স্থানটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি রোগী নিয়ে এসেছি। সকালে নাস্তা করা হয়নি, তাই চা-রুটি খাচ্ছি। এটা কিসের গেট জানি না। মনে হয়, হাসপতালেরই পুরাতন গেট। কোনো কারণে বন্ধ। অবশ্য যতবার এখানে এসেছি সবসময় বন্ধই দেখেছি।
পাশে চল্লিশোর্ধ দোকানি কালাম মিয়া বলেন, না, এটা হাসপাতালের গেট না। এখানে বায়ান্ন সালে অনেকে পুলিশের গুলিতে মারা গেছিল। তিনি ওই ব্যক্তিকে ফটকে লাগানো ব্যানারের দিকে ইঙ্গিত করেন।
যা বলছে ঢামেক কর্তৃপক্ষ
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকলে কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ঐতিহাসিক স্থানটি সংরক্ষণে তাদের পক্ষ থেকে যতটা করার তা করা হয়েছে। স্থানটিতে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। নিয়মিত দেয়ালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী রঙ করা হয়। এছাড়া আর কোনো কিছু তাদের হাতে নেই। যদি সরকারের পক্ষ থেকে কখনও কিছু করার জন্য বলা হয় সেটা করা হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কোনো আয়োজন থাকছে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রামের বাইরে আমাদের নিজস্ব কোনো কিছু নেই। ফলে আমতলা-কেন্দ্রিক আমাদের কোনো আয়োজন নেই। যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো আয়োজন থাকে তাহলে পালন করা হবে।
এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী স্থানটি সংরক্ষণে সবকিছু করা হয় বলেও জানান তিনি।
এমএইচ/