images

জাতীয়

স্ট্রিট ফুডের দোকানে ‘নীরব চাঁদাবাজি’

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:৫২ পিএম

  • ইঞ্চি মেপে ঠিক করা হয় চাঁদার হার
  • মিলেমিশে চাঁদাবাজি, চাঁদা না দিলেই উচ্ছেদ

রাজধানীর সব এলাকাতেই এখন স্ট্রিট ফুডের জয়জয়কার। ফুটপাত ছাড়াও বিভিন্ন সড়কে বিকেল হতেই জমে উঠে স্ট্রিট ফুডের পসরা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এসব স্ট্রিট ফুডের প্রতিটি দোকানেই চলে চাঁদাবাজি।

স্ট্রিট ফুড ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দোকানপ্রতি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। বিদ্যুতের জন্য দিতে হয় আলাদা টাকা। সব মিলে একটি দোকান চালাতে দৈনিক ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয় একজন দোকানীকে। এর সঙ্গে কোনো কোনো জায়গায় সপ্তাহের শেষেও আলাদাভাবে মোটা অংকের চাঁদা দিতে হয়। যার বেশিরভাগই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু সদস্যের পকেটে যায় বলে অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর ও ইস্কাটন এলাকার স্ট্রিট ফুড দোকানীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ভাগবাটোয়ারা ঝামেলায় আগারগাঁওয়ে দোকান বন্ধ

রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার পর্যটন ভবন, ইসলামী ফাউন্ডেশন ও নির্বাচন কমিশন এলাকার সামনের সড়কের দুই পাশে নিয়মিত স্ট্রিট ফুডের দোকান বসতো। ধুমসে চলতো বেচাকেনা। বাহারি সব খাবারের দোকানে ছিল উপচেপড়া ভিড়। সন্ধ্যার পর ফুডপ্রেমিদের ভিড়ে গমগম করতো। এমন দৃশ্য দেখা যেত গেল মাসের শেষের দিকেও। কিন্তু এখন প্রতিটি দোকান বন্ধ। সন্ধ্যার পর সেই এলাকা নীরব হয়ে যায়। প্রয়োজন ছাড়া কাউকে সেখানে আড্ডা বা ঘুরতে দেখা যায় না।

শুক্রবার রাতে গিয়ে দেখা গেল, রাস্তার দুই পাশে প্রায় অর্ধ শতাধিক দোকান বন্ধ। ভাসমান দোকানগুলোকে প্লাস্টিক, কাপড় ও বড় বড় ত্রিপল দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের বিপরীতে কয়েকটি হোটেলের কর্মচারীরা জানালেন, গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে কোনো দোকান বসার অনুমতি দিচ্ছে না ‍প্রশাসন। চাঁদার ভাগবাটোয়ারা ও প্রতি দোকানে চাঁদা কেমন হবে তা নিয়ে ঝামেলা চলছে। ফলে কোনো দোকান খুলতে পারছে না দোকানীরা।

একটি বন্ধ দোকানের মালিক সোহান তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা আপাতত বসতেছি না। কারণ ঝামেলা চলছে। চাঁদা নিয়ে ঝামেলা। এটা ঠিক না হওয়া পযন্ত কোনো দোকান বসবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

দোকানীদের অভিযোগ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে চাঁদার ভাগ নিয়মিত যেত। তাদের হয়ে একজন এই টাকা তুলতেন। তার ভাগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু সদস্যদের পকেটেও চলে যেত। কিন্তু কারও নাম বলতে চাননি দোকানীরা।

রুবেল নামে আরেক দোকানী ঢাকা মেইলকে বলেন, তাদের কথা মতোই চাঁদা তোলা হয়। আমরা দোকান করতে পারছি না। এখন চাঁদার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ঝামেলা চলছে ফলে আমরা কেউই দোকান খুলতে পারছি না। বিষয়টি কার কাছে জানাব?

তবে শেরে-বাংলানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল আহাদের দাবি, প্রশাসনের নির্দেশেই দোকানগুলো বন্ধ করা হয়েছে।

তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি নিজেই গিয়ে দোকানগুলো বন্ধ করে দিয়েছি। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র সেগুলো বন্ধের একটা নির্দেশ ছিল। তাদেরকে বলেছি এখানে কোনো দোকান করা যাবে না। আর সেখান থেকে আমি এক টাকা চাঁদা নিয়েছি কেউ বলতে পারবে না। অন্য কেউ চাঁদা নিয়ে সেগুলো চালাতো কিনা সেটা আমার জানা নেই।

ঢাকা উত্তর সিটির ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফোরকান হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, দোকানগুলো কেন বন্ধ তা বলতে পারি না। আর আপনারাও তো এ বিষয়ে ভাল জানেন। আমার ওয়ার্ডে কোনো ভাসমান দোকান চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি।

গত তিন দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, রাজধানীর আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর ও ইস্কাটন এলাকার ফুটপাত ও সড়কে যেসব স্ট্রিট ফুডের দোকান বসছে সেগুলোর অধিকাংশই স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের। এছাড়াও কিছু দোকান আওয়ামী লীগের নেতাদেরও রয়েছে।

পরীবাগের উল্টো পাশের সড়কটিতে সন্ধ্যা হলে ভিড় জমে যায়। ওভারব্রিজের সিঁড়ির সামনে থেকে দুই পাশে শুরু হয়েছে স্ট্রিট ফুডের দোকান। প্রতিটি দোকান চলে রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত।

কথা হয় কাবাব বিক্রয়কারী একটি দোকানের মালিকের সাথে। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সড়কটি ছয় মাস আগেও মাত্র চারটি দোকান বসতো। তার দোকানটি প্রথম শুরু হয়। পরে দোকানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন প্রায় ৩০টির মতো দোকান। বেশিরভাগই স্থানীয় ছাত্র নেতাদের।

এখানকার একজন নতুন দোকানদার ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রতিদিন তাকে তিন থেকে সাড়ে তিনশত টাকা চাঁদা গুনতে হয়। এজন্য একজন লাইনম্যান আছে। সেই চাঁদা তোলে। পরে তা ভাগ হয়ে যায়। প্রতিদিনের চাঁদার পাশাপাশি সপ্তাহ শেষে ১২শ টাকা আলাদাভাবে দেন।

যদিও প্রবাসী কল্যাণ ভবন থেকে পরীবাগ মোড় যাওয়ার সড়কটিতে কোনো দোকান বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল বাশার। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা এ রাস্তায় বসানোর জন্য কোনো দোকানদারকে বলিনি। আর রাস্তা দখল করে দোকান বসানোর অনুমতি সিটি করপোরেশন দেয় না। সেখানে কিছু লোক প্রশাসনের লোকদের ম্যানেজ করে দোকান বসিয়েছে।

ইঞ্চি অনুযায়ী দোকানের চাঁদা দিতে হয়!

মিরপুরের ১০ নম্বর এলাকার ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ের সামনে প্রতি ইঞ্চি দোকান বাবদ চাঁদা দিতে হয়। দোকানের দৈর্ঘ্য বেশি হলে চাঁদার পরিমাণও বেশি। আর বিদ্যুতের চাঁদা ধরা হয় বাল্বের সংখ্যা অনুযায়ী।

এক দোকানী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতি ৫৫ ইঞ্চির দোকানের জন্য ১৫০ টাকা, একটি বাল্ব জ্বালালে ৩০ টাকা দিতে হয়। আর ১০০ ইঞ্চির দোকানের জন্য দিতে হয় ৩০০ টাকা। দুটি বাল্বের জন্য ৬০ টাকা গুনতে হয়। ফায়ার সার্ভিসের সামনে, তার দুই পাশের ফুটপাতে প্রায় তিন শতাধিক দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে মিজান নামে এক যুবক চাঁদা তোলেন। এই মিজান হলেন সাহাদাত ও লিটনের ভাই। তারাই মূলত এসব দোকান বসিয়েছেন।

তিনি আরও জানান, এ সড়কের উল্টো পাশে আল বারাকা ভবনের সামনের সড়কটিতেও একইভাবে চাঁদা দিতে হয়।

এসব বিষয়ে জানতে ঢাকা উত্তর সিটির ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া সম্ভব হয়নি।

মোহাম্মদপুরের টাউন হলের সামনে অন্তত ২৮টি দোকান বসে। প্রতি দোকান থেকে প্রায় ৬০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। কয়েকজন দোকানী নাম না প্রকাশ করা শর্তে বলেন, তাদের এসব দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলা হয়।

কয়েকজন দোকানী জানান, নজরুল নামে একজন তার ভাগিনাকে দিয়ে এসব চাঁদা তোলেন।

এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহফুজুল হকের সাথে যোগাগোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এমআইকে