images

জাতীয়

ছেলেকে বাঁচাতে আগুনে ঝাঁপ দেন শারমিন

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:৫০ পিএম

চারপাশে তখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছিল বস্তিবাসী। ওই সময় বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলেন শারমিন (১৯) ও তার দেড় বছরের ছেলে নাফি। পাশেই ছিলেন শারমিনের মা লিপি বেগম। পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন তার ছোট ভাই লিখন। বস্তিতে আগুন লাগায় এলাকাবাসী তাদের রক্ষায় টিনের দরজায় আঘাত করে ঘুম ভাঙান। শারমিন ও তার মা আগুন টের পেয়েই ঘরে থেকে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু পরক্ষণই শারমিনের মনে পড়ে তার দেড় বছরের ছেলের কথা। তিনি দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়েন ছেলেকে রক্ষার জন্য। কিন্তু ততোক্ষণে ছেলের শরীরে আগুন লেগে পুঁড়ছে। এ দৃশ্য দেশে শারমিন আর স্থির থাকতে পারেননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘুরে ঢুকে পড়েন। কিন্তু ছেলেকে নিয়ে আর বের হতে পারেননি। ঠিক ওই সময় ঘরের ছাদ থেকে একটি টিন খসে পড়ে মা ও ছেলের ওপর। তারা আগুনের নিচে চাপা পড়ে যান। মুহূর্তেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যান মা ও ছেলে।

মর্মান্তিক এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর কারওয়ানবাজার রেললাইনের পাশে থাকা মোল্লারবাড়ী বস্তিতে। শনিবার (১৩ জানুয়ারি) ভোররাতে এই ঘটনা ঘটে।

আরও পড়ুন

‘এক টাকার জিনিসও বের করতে পারিনি, আমার সব শেষ’ 

দুপুরে ঘটনাস্থলে গেলে আগুনের পুড়ে নিহত শারমিনের প্রতিবেশী খালাতো বোন লাভলী আক্তার ঢাকা মেইলকে ঘটনার বর্ণনা শোনাচ্ছিলেন।

Sharmin2

শুধু শারমিন ও তার সন্তানই আগুনে পোড়েননি, তার ছোট ভাই লিখনও দগ্ধ হয়েছেন এই ঘটনায়। লিখনের একটি হাতের অর্ধেক পুড়ে গেছে। তাকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। মেয়ে ও নাতি আগুনে পুড়ে মর্গে আর ছেলে হাসপাতালে, এই নিয়ে এখন লিপির দৌড়ঝাঁপ। তিনি কারওয়ানবাজারে সবজি বিক্রি করেন।

লাভলী বলেন, ‘শারমিনের যখন ছেলে মারা গেছে তখন তিনি ভাবছিলেন তার বেঁচে থেকে কী হইবো। পরে উনিও মারা গেছেন। উনি তখন বারবার বলতাছিল, তার সন্তান মইরা গেছে, উনি বাইচা কী করবে! বাঁচার জন্য শেষে পাশে থাকা টিউবওয়েলের পাশে দাঁড়াইছিল, কিন্তু সেইখানেই পুইড়া মারা গেছে।’

আরও পড়ুন

‘এত মানুষের টাকা কই থেকে দেবো’ 

শারমিনের খালাতো বোন বলেন, ‘উনি ছেলেকে বাঁচাইতে যাইয়া টিন তার ওপর পইড়া গেছে। তখন আর বের হইতে পারেন নাই। মুহূর্তে পুরো ঘর ভাঙাইয়া আগুনে তারা পুইড়া গেছে।’

ব্যাগ গুছিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া হলো না শারমিনের

প্রতিবেশী লাভলী আক্তার জানাচ্ছিলেন, শারমিন দুই সপ্তাহ আগে বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। তার আগামী ১৫ জানুয়ারি জামালপুরের ইসলামপুরে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথাও ছিল। সেজন্য শারমিন শুক্রবার রাতেই যাবতীয় কাপড় গুছিয়ে ব্যাগও প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। কিন্তু আর যাওয়া হলো না।

তিনি আরও জানান, শারমিন তার বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। তিন থেকে চার বছর আগে পরিবারের অমতে ভালোবেসে মিজানুর রহমান নামের এক যুবককে বিয়ে করেন। মিজান কারওয়ানবাজারে সবজির ব্যবসা করেন। অমতে বিয়ে করায় দীর্ঘদিন পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক ছিল না। শ্বশুরবাড়ির লোকজনও আসতে দিতো না। সম্প্রতি বিষয়টি মেনে নেওয়ায় বাবার বাড়ি যাতায়াত করছিলেন তিনি। সবশেষ এসেছিলেন বেড়াতে। কিন্তু বেড়াতে এসেই তিনি ও তার একমাত্র সন্তান আগুনে পুড়ে লাশ হয়ে এখন ঢামেকের মর্গে রয়েছেন।   

Sharmin3

যে ঘরে পুড়ে শারমিন ও তার দেড় বছরের ছেলে নাফি মারা গেছে সেই ঘরের কোনো অস্তিত্ব এখন নেই। শুধু পোড়া কাঠ, টিন আর কালো কয়লার স্তুপ।

লাভলীর সাথে যখন কথা হচ্ছিল তখন তিনি হাতের আঙ্গুলে ইশারা দিয়ে সেই ঘরটি দেখাচ্ছিলেন। কিন্তু সেই ঘরের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে শনিবার গভীর রাতে লাগা আগুনে।

আরও পড়ুন

‘কোনোমতে জানডা নিয়া বাইর হইছি’ 

এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুইজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ। এছাড়া আরও কয়েকজন দগ্ধ হয়ে ঢামেকে ভর্তি রয়েছেন। তবে আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে এখনো জানাতে পারেনি কোনো দফতর। পুলিশ বলছে, তদন্তসাপেক্ষে তারা বিষয়টি বলতে পারবেন। ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি করেছে। সেই প্রতিবেদন পেলে জানা যাবে আগুন লাগার কারণ।

এমআইকে/জেবি