মোস্তফা ইমরুল কায়েস
২৬ আগস্ট ২০২৩, ০৮:১৬ পিএম
সাধারণত কোন মোবাইল ফোন কোম্পানির নামে সিম কেনার জন্য গ্রাহকককে রেজিস্ট্রেশন করতে আঙ্গুলের ছাপ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে হয়। আর এটাই সিম কেনার সরকারি নিয়ম। কিন্তু এই রীতিতেও একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির নামে গ্রামে আসা কিছু ব্যক্তির কাছ থেকে সিম কিনে ফেঁসে গেছেন পুরো গ্রামবাসী। তাদের নামে মামলাসহ নোটিশ জারি হয়েছে। মামলা ও নোটিশ পেয়ে তারা এখন দিশেহারা। বাদ যায়নি গ্রামের ভিক্ষকুও। কীভাবে এই সিম কিনল প্রতারকরা, আর কারা এসব সিম সরবরাহ করেছিল, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ঢাকা মেইলের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মোস্তফা ইমরুল কায়েস প্রায় এক মাস অনুসন্ধান চালিয়েছেন। তার অনুসন্ধানে ধারাবাহিক দুই পর্বে বেরিয়ে এসেছে ঘটনার মূল রহস্য ও নেপথ্যের গল্প। আর আজ থাকছে দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
গেল বছর দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থানার বড় শ্যামনগর গোতামারী গ্রামে আসে কয়েকজন যুবক। ওই গ্রামের লোকজন তাদের কাছ থেকে কম দামে একটি মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরের অর্ধশতেরও বেশি সিম কিনেছিলেন। তারা সিমগুলো ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ব্যবহারও করছিলেন। কিন্তু এখন সিমগুলো তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, প্রতারক চক্র তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও চোখের ছাপ নিয়ে খুলেছে ভুয়া বিকাশ, নগদ ও রকেটে অ্যাকাউন্ট। আর এসব অ্যাকাউন্ট দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র। ফলে মামলা হওয়ার পর প্রতারক চক্রের সঙ্গে গ্রামটির অনেকেই আসামি হয়েছেন। ইতোমধ্যে এই গ্রামের অনেকের নামে মামলায় হাজির হওয়ার নোটিশও এসেছে। যাদের নামে নোটিশ আসেনি তারাও এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে গ্রামবাসীর।
এখন পর্যন্ত গ্রামের ছয়জনের নামে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তুলে শরীয়তপুরের সিআইডির পক্ষ থেকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তারা এমন নোটিশ পাওয়ায় সিম নেওয়া বাকীরা বিষয়টি যাচাই করতে গিয়ে তাদের চোখ ছানাবড়া। জানতে পারেন তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, আঙুল ও চোখের ছাপ নিয়ে সিম না দেওয়া হলেও সিম রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। সেগুলো কিছুদিন আগেও সক্রিয় ছিল।
গ্রামবাসী জানিয়েছে, সিম বিক্রির নামে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র নিয়ে প্রতারক চক্র বিকাশ, নগদ ও রকেটে অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণা করেছে। এখন প্রতারণার শিকার সেই ভুক্তভোগীরা মামলা করায় তারাও আসামি হয়েছেন। ফলে এসব মামলায় হাজিরা দিতে কাউকে মাদারীপুর আবার কাউকে শরীয়তপুর পর্যন্ত ডাকা হয়েছে। অপরাধ না করেও এমন নোটিশ পেয়ে তাদের এখন থানায় ছুটতে হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত গ্রামের ছয়জনের নামে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তুলে শরীয়তপুরের সিআইডির পক্ষ থেকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তারা এমন নোটিশ পাওয়ায় সিম নেওয়া বাকীরা বিষয়টি যাচাই করতে গিয়ে তাদের চোখ ছানাবড়া। জানতে পারেন তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, আঙুল ও চোখের ছাপ নিয়ে সিম না দেওয়া হলেও সিম রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। সেগুলো কিছুদিন আগেও সক্রিয় ছিল। এরপর গ্রামের প্রায় শতাধিক মানুষ ছুটে যান দিনাজপুরে। সেখানে গিয়ে তারা তাদের নামে সক্রিয় থাকা অন্তত অর্ধশত সিম বন্ধ করে দিয়েছেন।
তাদের নামে অতিরিক্ত সক্রিয় থাকা সিমগুলো বন্ধ করা হলেও আতঙ্ক কাটছে না। শুধু সিম সক্রিয় করেই প্রতারণা করা হয়নি। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েও বিকাশ ও নগদে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। যেগুলো দিয়ে প্রতারক চক্র আরও মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়েছে কিনা তা তারা নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে কখন কার নামে থানা থেকে নোটিশ চলে আসে সেই আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা সবার মাঝে তাড়া করছে।
গ্রামবাসী ও ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তিনজন যুবক সেই গ্রামে সিম বিক্রির জন্য গিয়েছিল। তাদের কাছ থেকে ওই গ্রামের অনেক নারী ও পুরুষ সিম কেনেন। এরপর থেকে সিমগুলো ব্যবহারও করে আসছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে চলতি বছরের মে মাস থেকে তাদের নামে একের পর এক মামলায় হাজির হওয়ার জন্য নোটিশ আসা শুরু করে। অনেকে নোটিশে উল্লেখিত জেলায় গিয়ে স্বশরীরে হাজিরাও দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ মান-সম্মানের ভয়ে বাদীর সাথে আপোষ করেছেন। কিন্তু তারপরও বন্ধ হয়নি নোটিশ।
তাদের কেউ কেউ বিষয়টি সমাধানের জন্য শরীয়তপুরেও গেছেন। যার যা সামর্থ্য সেই পরিমাণ টাকা দিয়ে মামলার বাদীকে ক্ষতিপূরণও দিয়ে এসেছেন।
এ গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা এখন সব সময় আতঙ্কে আছি। কখন কার নামে থানা থেকে নোটিশ আসে। যদিও আমরা যার যার নামে সিম তোলা হয়েছে, বিকাশ এবং নগদে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল সেগুলো ইতোমধ্যে বন্ধ করে এসেছি। কিন্তু ভয় কাটছে না।
আতঙ্কে পুরো গ্রামবাসী
চিরিরবন্দর থানার বড় শ্যামনগর গোতামারী গ্রামের জয়নব পারভীন বলেন, ‘হামার রাইতের ঘুম হারাম হয়া গেইছে। কখন কার নামে নোটিশ আইসে হামরা সেই আতঙ্কে আছি বাহে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেদিন লোকগুলা হামার সবারে দুই তিন বার করি ছাপ নিলো কিন্তু সিম তো দিলো না। এখন হারা শুনবার পাচি হামার নামে চাইর পাইচটা সিম তোলা হইছে।’
একই গ্রামের মোতালেব জানান, তার নামে চারটি সিম তোলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি জানতেন না। এছাড়াও তার স্ত্রী নারগিসের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে প্রতারক চক্র দুটি রকেট অ্যাকাউন্ট খোলে। যা এখন তারা বন্ধ করেছেন। কিন্তু স্বামী ও স্ত্রীর আতঙ্ক কাটছে না।
তিনি আরও জানান, ওই গ্রামে ভিক্ষা করে খায় এমন লোকের নামেও নোটিশ গেছে। পরে এলাকাবাসী সাহায্য সহযোগিতা করে তাদেরকে মামলা থেকে অব্যাহতির চেষ্টা করেন। তবে ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করলেও অনেকের নামে নোটিশ আসায় তাদের মাঝে এখন বেশ ভয় কাজ করেছে। স্থানীয় থানায় বিষয়টি জানানো হলে তারা সিমগুলো বন্ধের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
মোতালেব বলেন, ‘হামরা তো নাম্বার বন্ধ করছি কিন্তু কখন নোটিশ আইসে এ ভয়ে আছি।’
একই গ্রামের আরমিনা বলেন, ‘সবায় কান্নাকাটি করছে। হামরা তো ভ্যান চালে খাই। কি যে হইবে এই ভয়ে আছি। নোটিশ হামার নামে এখনো আইসে নাই কিন্তু আইসতে কতোক্ষণ!’
প্রতারক থেকে রক্ষা পেতে গ্রামবাসীর থানায় জিডি
গত ছয় মাসে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার ৬নং অমরপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের বড় শ্যামনগর গোতামারী গ্রামের ২০ জনের মতো মানুষের নামে প্রতারণার মামলা নোটিশ আসার পর তারা এখন চোখে সরষে ফুল দেখছেন। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ বিষয়টি থানাও জানিয়েছেন। গত ৩ আগস্ট পুরো গ্রামের দেড় শতাধিক মানুষ গিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। তাদের ভাষ্য হলো এই হয়রানি থেকে তারা রক্ষা পেতে চান।
>> আরও পড়ুন: ‘সিম কিনে’ যেভাবে ফাঁসলেন পুরো গ্রামের বাসিন্দারা
তারা জানিয়েছেন, গ্রামের বেশির ভাগ নারী ও পুরুষের নামে শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর থেকে মামলার নোটিশ এসেছে। প্রতারণা না করেও মামলার নোটিশ আসায় তারা অনেকে বিব্রত। শুধু কি তাই, এমন সংবাদ পেয়ে অনেকের পরিবার থেকে যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছে।
ভুক্তভোগী এক নারী নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, আমার পরিবার তো বিষয়টি শুনে রীতিমতো শকট। তাদের নাকি মান সম্মান চলে গেছে। তারা আমাকে কি সমাধান দেবে উল্টো আমাকে গালমন্দ করে যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে। তবে পুলিশ বিষয়টি তদন্তে বুঝতে পেরেছে আমরা আসলে এমন কাজ করিনি।
ভুক্তভোগীরা আরও জানিয়েছেন, তাদের নামে একের পর এক নোটিশ আসার পর তারা হতবাক হয়ে যান। ফলে স্থানীয়ভাবে তারা ওই গ্রামে সকলে বসে সিদ্ধান্ত নেন যে, বিষয়টি নিয়ে থানায় যাবেন এবং ওসিকে জানাবেন। তবে তা করেছিলেন তারা।
চিরিরবন্দর উপজেলার ৬নং অমরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল কাজী ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার কাছে এমন ভুক্তভোগীরা এসেছিল। তাদের নিয়ে থানায় গিয়েছিলাম। বিষয়টি থানা পুলিশকে জানানো হলে তারা জিডির পরামর্শ দেন। পরে অনেকে জিডিও করেছে।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থানার বড় শ্যামনগর গোতামারী গ্রামের ভুক্তভোগী জয়নব বেগম জানান, তাদের পরিবারের চার সদস্যের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে প্রতারক চক্র বিকাশে পৃথক অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। পরে তারা বিষয়টি জানতে পেরে বন্ধ করেছেন।
এ বিষয়টি জানার পর বড় শ্যামনগর গোতামারী এলাকার বাসিন্দা জয়নার পারভীনসহ তার পরিবারের সদস্য ছালনা বেগম, মৌসুমী আক্তারও শিরিন আক্তার চিরিরবন্দর থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন। তারা প্রতারক চক্রের হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
গত ৩ আগস্ট তাদের মতো অন্তত দেড় শতাধিক নারী ও পুরুষ চিরিরবন্দর থানায় গিয়েছিল। পরে থানার অফিসার ইনচার্জ বজলুর রশিদ তাদের সাথে কথা বলেন এবং বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বাস দেন। এরপর তারা নিজ নিজ বাড়িতে চলে যান।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, তারা গত এক বছরেও জানতেন না তাদের নামে সিম তোলা হয়েছে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে প্রতারক চক্র এমন ভয়াবহ প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়েছে। তবে নোটিশ না আসলে তারা বিষয়টি জানতেন না। তবে নোটিশ আসার পর তাদের অনেকে বিষয়গুলো সমাধানও করেছেন। কিন্তু এখনো তারা আতঙ্কে আছেন। কখন কার নামে কোন জেলা থেকে নোটিশ এসে বসে।
এ ব্যাপারে চিরিরবন্দর উপজেলার ৬নং অমরপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা ভুক্তভোগীদের নিয়ে থানায় গিয়েছিলাম। এরপর ওসি বলল আপনারা এমন সিম আর কিনবেন না।
৬নং অমরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল কাজী ঢাকা মেইলকে বলেন, আসলে বিষয়টি তো আতঙ্কের। যারা সিম কিনেছে তারাই এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তবে তাদের ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে পুলিশকে বলেছি। পুলিশও এসব সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হন তার জন্য ভালো রিপোর্ট দেবেন বলে বলেছে। এ বিষয়ে আমি তাদের পাশে আছি।
চিরিরবন্দর থানার ওসি বজলুর রশিদ বলেন, তারা আমার কাছে এসেছিল আমি তাদের বলেছি তারা যেনো আর এ ধরনের সিম না কিনে। তবে তাদের দেখে আমার অসহায় মানুষ মনে হয়েছে। এর মধ্যে স্কুল শিক্ষিকাও আছেন। আমরা থানা থেকে তদন্ত করেছি। তাদের ব্যাপারে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে পজিটিভ রিপোর্ট দেওয়ার জন্য বলেছি।
শরীয়তপুর সিআইডির এসআই মুজিবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা গ্রামের লোকজনের উদ্দেশে বলব আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে মামলার তদন্তের স্বার্থে তাদেরকে আমরা হাজির হওয়ার জন্য নোটিশ পাঠিয়েছিলাম। পরে দেখি যাদের নামে নোটিশ পাঠানো হয়েছে তারাও এক প্রকার ভুক্তভোগী।
এমআইকে/এএস