ঢাকা মেইল ডেস্ক
২৪ আগস্ট ২০২৩, ১০:৪৬ পিএম
উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর সংস্থা ব্রিকস নতুন করে ছয়টি দেশকে অর্থনৈতিক জোটের সদস্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আগে থেকেই এর সদস্য ছিল। তবে নতুন করে আমন্ত্রণ জানানো ছয়টি দেশের তালিকায় নাম নেই বাংলাদেশের। এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতির বিষয়গুলোকে সামনে আনছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। খবর বিবিসির
যদিও ব্রিকসের ১৫তম বৈঠকে জোটটির সঙ্গে বাংলাদেশের যুক্ত না হওয়ার বিষয়টিকে এখনই কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন না তারা। বিশ্লেষকদের দাবি, প্রকৃত কারণ জানতে হলে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
তবে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, এবার সদস্যপদ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে ব্রিকস। বাংলাদেশ হয়তো সেসব বিষয়ে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকায় এই দফায় সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচিত হয়নি।
বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) ব্রিকস সম্মেলনের শেষ দিনে জোটে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছে আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। স্বাগতিক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা এ কথা জানিয়েছেন। আর আগে থেকেই ব্রিকসের সদস্য হিসেবে রয়েছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা।
যদিও বাংলাদেশও এই জোটে যোগ দিতে পারে বলে এর আগে আভাস মিলেছিল। তবে সর্বশেষ নতুন সদস্য দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত না হওয়া নিয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি বাংলাদেশ।
গত ২২ আগস্ট ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ২৬ আগস্ট স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের (ইকে৭৬২) ফ্লাইটে জোহানসবার্গের ও. আর. টাম্বো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দেশের উদ্দেশে রওনা দেবেন সরকারপ্রধান।
এর আগে ব্রিকসের সদস্যপদের বিষয়ে চলতি বছর জুনের মাঝামাঝি সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছিলেন, অগাস্টে বাংলাদেশ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট-ব্রিকসের সদস্য পদ লাভ করতে পারে।
বাংলাদেশের ব্রিকসে যুক্ত না হওয়ার সম্ভাব্য কারণ
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে ব্রিকসে সম্মেলনের পাশাপাশি বুধবার (২৩ আগস্ট) চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘(চীন বলেছে) ব্রিকসে যাতে বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারে, সেই জন্যে আমাদের সবসময় সমর্থন থাকবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বার্তা থেকে আশা তৈরি হয়েছিল, এবার হয়তো বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্যপদ পাবে। তবে বৃহস্পতিবার ব্রিকস সম্মেলনের শেষ দিনে জোটটিতে যোগ দিতে যেসব দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, সেখানে বাংলাদেশের নাম নেই।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, প্রথমত ব্রিকসে যাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তার মধ্যে সবগুলো দেশই অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে অগ্রসরমান দেশ এবং এদের সবার অর্থনৈতিক অবস্থাই বাংলাদেশের তুলনায় ভালো।
তিনি বলেন, ‘আমরা তো এখনো এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবেই আছি। আর ব্রিকসে যারা আছে তাদের লেভেলটা তো আরেকটু উপরে।’
সাবেক এই রাষ্ট্রদূতের মতে, বিকল্প একটা অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করার মতো সক্ষমতা রাখে এমন সব দেশকেই এবার ব্রিকসে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সেই জায়গায় বাংলাদেশ এখনো সে ধরণের ভূমিকা পালন করতে পারবে কি না সে বিষয়টিও হয়তো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
তবে এবার ব্রিকসে যোগ দিতে না পারার বিষয়টিকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে নারাজ সাবেক এই কূটনীতিক। তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় কারণ হতে পারে যে আমরা সাম্প্রতিক কালে আগ্রহ দেখিয়েছি। কাজেই আগ্রহ দেখানো এবং তার জন্য মোবিলাইজেশন যেটা দরকার সেটা কতটুকু হয়েছিল সেটা ব্যাপার। আর আমার ধারণা সে কারণেই বিষয়টা হয়তো বিবেচনায় আসে নাই।’
তিনি বলেন, ‘এটা ব্যর্থতা বলব না। এটা বলতে পারেন যে, আমরা একটু বেশি প্রত্যাশা হয়তো করেছিলাম। অথবা এটাকে আশাবাদ তৈরি করে একটা অবস্থান বা একটা ভাবমূর্তি তৈরি করার জন্য হয়তো চেষ্টা করা হয়েছিল যা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।’
বিষয়টি নিয়ে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ বলেন, বাংলাদেশ বাদ পড়ার যথাযথ কারণ জানতে অপেক্ষা করা উচিত।
তাঁর মতে, এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে, চারটি দেশকে যুক্ত করা হলে তার মধ্যে একটি বাংলাদেশ হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা দেখা যায়নি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ বলেন, ‘এর কারণ হতে পারে, তারা যে ক্রাইটেরিয়া বিবেচনায় নিয়েছে সেগুলোর সাথে হয়তো বাংলাদেশ ম্যাচ করেনি, পরবর্তীতে যখন তারা আবার অ্যাড করবে তখন হয়তো আসতে পারে। তবে এগুলো সবই ধারণা মাত্র।’
ব্রিকসে বাংলাদেশের যুক্ত না হওয়াকে এখনই কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন না তিনি। সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘সব কিছুতেই তো আর দিনে দিনে সাফল্য পাওয়া যায় না, অনেক কিছু আছে যেগুলোতে অনেক সময় লাগে।’
বিষয়টিতে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘কোন সূচকের ভিত্তিতে নতুন সদস্য নেওয়া হবে কিনা কিংবা কীভাবে গ্রহণ করা হবে- এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে অর্থনীতির আকার ও জাতীয় মাথাপিছু আয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই বলা যায়, নতুন সদস্য নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরোপুরি ঐক্যমত না থাকলে একটি মাপকাঠি ছিল’
এই অর্থনীতিবিদের ভাষ্য- অর্থনীতির আকার এবং জাতীয় মাথাপিছু আয় এ দুটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের চেয়ে ইথিওপিয়া ছাড়া অন্য দেশগুলো, অর্থাৎ যাদের সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে তারা এগিয়ে।
একই কথা জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস। বিষয়টিকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে চান না তিনি। ড. নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, বাংলাদেশ নিজে থেকে এখানে আগ্রহ দেখিয়েছে বিষয়টি সেরকম নয়। বরং বাংলাদেশকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং সেখানে বাংলাদেশ ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে।
ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘সেই কনটেক্সটে এটাকে ঠিক এখনই ফেইলিয়র বলাটা, অত্যুক্তি করা হয়ে যাবে। আরেকটু বোধ হয় এটা অ্যানালিসিস করতে হবে।’
তবে যেসব দেশকে ব্রিকসে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করার মতো বলে মনে করেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, চীন যেসব দেশে সমস্যা মেটাতে মধ্যস্থতা করেছে, সেসব দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যেমন সৌদি আরব এবং ইরান। আবার ইথিওপিয়াতে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে।
এছাড়াও আঞ্চলিক একটা ভারসাম্যও মাথায় রাখা হয়ে থাকতে পারে বলেও মনে করেন তিনি। যেমন- ছয়টি দেশের মধ্যে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকা- সব এলাকার দেশই রয়েছে।
/আইএইচ