images

জাতীয়

উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে পরিচয়হীন নবজাতক, সমাধান কীসে?

খলিলুর রহমান

২৪ আগস্ট ২০২৩, ১১:২২ এএম

মাতৃগর্ভে আসার পর থেকে একজন সন্তানকে পৃথিবীতে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতির অন্ত থাকে না গোটা পরিবারের। কবে আসবে সন্তান সেই প্রতীক্ষার যেন অবসানই হতে চায় না। অথচ অনেক সন্তানকে দুনিয়াতে আসার পরই নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়। জন্মের পর যার ঠাঁই হওয়ার কথা মায়ের কোলে, অথচ সেই নবজাতকের ঠিকানা হয় ডাস্টবিন কিংবা রাস্তার পাশে। এর মধ্যে কাউকে জীবিত আবার কাউকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝেমধ্যেই ডাস্টবিনে পড়ে থাকা নবজাতককে উদ্ধার করা হয়। কাউকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন পথচারীরা। আবার কেউ তুলে দেয় প্রশাসনের জিম্মায়। তবে বেশিরবাগ হতভাগ্য নবজাতকের স্থান হয় হাসপাতালের মর্গে। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা করা হলেও ধরা পড়ে না কোনো আসামি।

উদ্বেগজনকহারে এই সংখ্যাটা বাড়লেও কেন এমন ঘটনা ঘটছে তার উত্তর জানা নেই সমাজকর্মী, অপরাধ বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদেরও? এখন পর্যন্ত একটি ঘটনারও তথ্য উদ্ঘাটন না হওয়ায় নবজাতকদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। কারাই বা এসব নবজাতককে রাতের আঁধারে ফেলে যাচ্ছেন তাও থেকে যাচ্ছে অজানা। এসব নবজাতকের সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর আচরণের দায় কার? বাবা, মা নাকি পৃথিবীর কোনো নিষ্ঠুরতার!

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আশপাশ এলাকায় এমন ঘটনা বেশি ঘটে। শাহবাগ থানা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর শাহবাগ থানার আওতাধীন এলাকার ডাস্টবিন ও নর্দমা থেকে ১০-১২টি নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মরদেহ উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত হয়। তারপর মরদেহের ডিএনএ প্রোফাইলের জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়। এছাড়া ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজও বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে জড়িতদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। চলতি বছর একটি নবজাতকের পরিচয়ও শনাক্ত করা যায়নি।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নবজাতক উদ্ধার হওয়ার পর মামলা হয়। মরদেহের ময়নাতদন্তও হয়। সেই ময়নাতদন্তের ওপর ভিত্তি করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করে। কিন্তু শিশুটির পিতৃ কিংবা মাতৃ পরিচয় শনাক্ত হয় না। ফলে এমন কর্মকাণ্ডের জন্য যারা দায়ী, তাদের আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাচ্ছে না। কোনো বিচার না হওয়ায় এমন ঘটনা বাড়তে থাকে।

child
ফাইল ছবি

জানা যায়, গত ১২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের পাশের ময়লার স্তূপ থেকে দুই নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীটি জানায়, দুটি জমজ নবজাতক লুঙ্গি দিয়ে পেঁচানো ছিল। কেউ তাদের এখানে ফেলে রেখে গেছে বলে ধারণা তাদের। পরে জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল পেয়ে শাহবাগ থানা পুলিশ নবজাতক দুটির মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পাঠায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় জড়িতদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

তার এর মাস আগে ১৩ জুলাই শাহবাগ থানার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনের ফুটপাত থেকে একদিনের নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহটি উদ্ধারের পর শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শামীম ঢাকা মেইলকে বলেছিলেন, আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে কে বা কারা ওই নবজাতককে ফেলে গেল সেটি জানার চেষ্টা করছেন তারা।

এর এক মাস ৯ দিন পর গত মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) রাতে এসআই শামীমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করছিলাম। কিন্তু কে বা কারা ফেলে গেলে তা পাওয়া যায়নি। তবে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

এমন ঘটনা দিন দিন কেন বাড়ছে। এ থেকে মুক্তিরই বা উপায় কী, জানতে চাইলে পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, পরকীয়া বা অবৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে জন্ম নেওয়ার সন্তানদের ভাগ্য এমনটা বেশি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও আশপাশ এলাকার ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে সিজার করাতে আসে। চিকিৎসকরা বিষয়টি পুলিশকে অবগত করলে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, পরকীয় নিয়ে সামাজিকভাবেও কাজ করতে হবে। তা হলে ওই ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসা সম্ভব।

পুলিশের কাজ সম্পর্কে এসআই শামীম বলেন, আমাদের কাজ হলো যারা নবজাতককে ফেলে যায় তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা।

গত ২ জুলাই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নির্মাণাধীন বুয়েট সেন্টারের সামনের রাস্তা থেকে একটি নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহ উদ্ধারের পর সেটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান চকবাজার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) উদয়ন বড়ুয়া।

মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) রাতে এসআই উদয়ন বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ওই নবজাতকের বাবা-মা’র পরিচয় এখানা জানা যায়নি। এমনকি কে বা কারা তাকে ফেলে গেছে সে ব্যাপারেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

child
মাদারীপুর পৌরসভার বটতলা এলাকার থেকে কম্বল প্যাঁচানো এক নবজাতক কন্যা শিশুকে উদ্ধার করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

শুধু তাই নয়, এনজিও ও গণমাধ্যমের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর সারাদেশে অর্ধশতাধিক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ জুলাই বগুড়ার শিবগঞ্জে বাড়ির সামনে ফেলে যাওয়া শপিংব্যাগ থেকে এক মেয়ে নবজাতক উদ্ধার হয়। পরে বগুড়া টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড রফাতুল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

গত ২৫ জুলাই ঢাকা নার্সিং কলেজের গেটের পাশ থেকে শপিংব্যাগের মধ্যে কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় একদিন বয়সী এক ছেলে নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ১০ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পাশের রাস্তায় কুকুরের মুখ থেকে এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

গত ২৬ মে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসের ডাচ্-বাংলা এটিএম বুথের পাশে ডাস্টবিন থেকে কাপড়ে মোড়ানো এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১১ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার সদর হাসপাতালের নতুন ভবনের সামনে ময়লার স্তূপ থেকে এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশ যত আধুনিকতার দিকে যাচ্ছে ততই এমন ঘটনা বাড়ছে। বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামী পরিত্যক্ত কিংবা ধর্ষণ থেকে জন্মানো শিশুগুলোর ক্ষেত্রেই এমন পরিণতি বেশি হচ্ছে। জন্মের পরপরই এসব নবজাতকের ঠাঁই হচ্ছে ডাস্টবিনে অথবা রাস্তার পাশে। তবে ফেলে যাওয়া নবজাতকের পিতা-মাতার পরিচয় শনাক্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনলে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রভাষক এ বি এম নাজমুস সাকিব ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এখন আমরা মর্ডান যুগে বসবাস করছি। আমাদের সমাজে চলার পথে এখন আমূল পরিবর্তন এসেছে। আগে আমরা যে সমাজে বসবাস করতাম, সেখানে পরিবার ছিল বড় পরিবার, কিন্তু এখন একক পরিবারের চলে আসছি। আগে পরিবারগুলোতে একটা অনুশাসন ছিল। তখন সামাজিকরণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পরিবার থেকে পালন করা হতো। এতে আমরা একটা সুশৃঙ্খল জীবন লিড করতাম। কিন্তু মর্ডান যুগে এসে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনগুলো কমে যাচ্ছে। তাই এ ধরণের ঘটনা বেশি হচ্ছে।’

এ থেকে মুক্তির উপায় জানতে চাইলে নাজমুস সাকিব বলেন, এখন মর্ডান সমাজ থেকে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে এ থেকে বাঁচতে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে এগুলো গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। তাছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন বৃদ্ধি করলে এমন অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব।

কেআর/এমআর