দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
০১ আগস্ট ২০২৩, ০৬:৩৫ এএম
একটু আগেই ঝুম বৃষ্টি। গাছের পাতা থেকে এখনও টপ টপ শব্দে পানি পড়ছে। এরইমধ্যে রোদের ঝিলিক। কলাপাতার ডাল ছায়া হয়ে দোল খাচ্ছে লেকেরে পানিতে। বৃষ্টিতে শাপলা পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একদল হাঁস ফের পানিতে ভাসছে। পথ ধরে যাতায়াত করা কারও কারও যেন এক মিনিট দাঁড়ানোর সময় নেই। আবার কেউবা এমন দৃশ্য দেখছিলেন লেক পাড়ে দাঁড়িয়ে। কেউবা হাঁসের জলকেলি ক্যামেরা বন্দি করছেন। এ দৃশ্য স্থায়ী হলো সামান্য সময়ই। কারণ, দুই পথশিশুর পর পর ঢিলে হাঁসগুলো সরে গেছে। ফের বৃষ্টিও নেমেছে। এমনটাই দেখা গেল গুলশান শুটিং ফেডারেশনের বিপরীত পাশে ডা. ফজলে রাব্বি পার্ক লাগোয়া বাহিরের লেকে। পার্ক এবং লেক একই স্থানে হলেও পার্কে বসে এমন দৃশ্য উপভোগ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, প্রকৃতির দান লেক আড়াল করেই করা হয়েছে এ পার্কটির উন্নয়ন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কথা ছিল দশ মাসের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ হবে। আধুনিকায়নের নামে তিন বছর পার্কটির চারপাশ টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল। কিছুদিন আগে খুলে দেওয়া হলেও কাজ এখনও চলমান। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়নি এখনও। এলাকাবাসীর প্রতিবাদ, মানববন্ধন, বিক্ষোভে একপ্রকার বাধ্য হয়ে খুলেছে পার্কের দরজা। বর্তমানে পার্কটিকে দীর্ঘ উঁচু অস্বচ্ছ গ্লাসে মোড়ানো হয়েছে, যা খোলা পার্কটি আবদ্ধ রূপ দিয়েছে।
সিটি করপোরেশন বলছে, যাদের উন্নয়ন কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের অবহেলায় এমন দীর্ঘসূত্রিতা। তারা আন্তরিক হলে হয়তো আরও আগেই এ কাজ শেষ করা যেত।
এছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার না করে বিদেশি জিনিস ছাড়া কাজ হবেনা, এমন সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়াররা। সবশেষ তারা বলছেন, সময়ক্ষেপণ ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বর্তমান উন্নয়ন কাজ নিয়ে সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্টরা সন্তুষ্ট না। দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা গেলে আরও আগেই উন্নয়ন কাজের ইতি টানা যেত, সুফল পেত নগরবাসী।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ‘উন্মুক্ত স্থানসমূহের আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও সবুজায়ন’ প্রকল্পের আওতায় গুলশান-১ নম্বরের শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি পার্ক সংস্কারে কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০২০ সালের জুলাইয়ে। করোনা পরিস্থিতির কারণে পার্কটির অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ বন্ধ ছিল। এরপর কয়েকদফা বাড়ানো হয় কাজের মেয়াদ। বর্তমানে পার্কটির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পার্কটি উদ্বোধন করার প্রস্তুতি চলছে। এছাড়াও নানা কারণে পার্কটির নকশায় বারবার পরিবর্তন আনা হয়, যার প্রভাব পড়ে নির্মাণ কাজে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, টিনের সীমানা প্রাচীর খুলে দেওয়া হয়েছে। ভেতরের অংশে হাঁটার টাইলস বসানো শেষ হয়েছে। উত্তর পাশে করা হয়েছে বড় আকৃতির একটি ফটক। পশ্চিম পাশে ছোট পুকুর তৈরি করা হয়েছে, যেখানে কৃত্রিম ঝর্ণা থাকবে। সেই কাজ চলছে বেশ ধীর গতিতেই। চারপাশে ব্যারিকেড তৈরি করা বেশ উঁচু অস্বচ্ছ গ্লাসে আটকা পড়ছে বাতাস, যা দিয়ে বাহিরের পরিবেশ খুব বেশি দেখা যায় না।
এ সময় আরও দেখা যায়, পার্কটিতে হাঁটাচলার জন্য ওয়াকওয়ের কাজ শেষ। সাইকেল ট্র্যাক, ফোয়ারা, শিশুদের খেলনা বসানো হচ্ছে। শরীরচর্চার জন্য যন্ত্রপাতি, নারীদের বসার আলাদা স্থানও নির্মাণ করা হয়েছে। গাছের পানি নিষ্কাশন, টয়লেট নির্মাণ, সুপেয় পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সন্ধ্যার পর চলাচল নিশ্চিতে লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দূর থেকে পার্কটি দৃশ্যমান করতে এবং শব্দ যেন না আসে সেজন্য চারপাশে ১৫ ফুট উঁচু (বিশেষ অস্বচ্ছ গ্লাস সদৃশ) দেওয়াল বসানো হয়েছে।
বদ্ধ পরিবেশের নামে পার্কের এমন উন্নয়ন নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, পার্কটি একটা আবদ্ধ ঘরে পরিণত করা হয়েছে। চারপাশে দীর্ঘ উঁচু গ্লাস দেওয়া হয়েছে। লেক পাড় পুরোটা গ্লাসে ডাকা পড়েছে। না বইছে বাতাস, না দেখা যাচ্ছে লেক পাড়ের সৌন্দর্য। লেক থাকতে করা হয়েছে কৃত্রিম লেক (পুকুর)-ঝর্ণা। এটা কেমন পরিকল্পনা, কেমন কি বুঝে আসেনা। পাশের সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থেকে যেন গন্ধ না আসতে পারে, এমন সিদ্ধান্ত থেকে যদি অস্বচ্ছ গ্লাস দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে লেক পাড় কেন আড়াল করা হলো? অন্তত স্বচ্ছ গ্লাস তো দেওয়া যেত।
গুলশান-১ বাসিন্দা ইফফাত সানজিদা তার তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে এসেছেন পার্কে। আলাপকালে বলেন, এখনও তো সেভাবে কাজ শেষ হয়নি। পার্কেও গরম। বাতাস বইতে পারছেনা গ্লাসের জন্য। কিছু গাছও মনে কয় কাটা পড়েছে। লেক পাড় আড়ালে চলে গেছে। বাচ্চা বার বার লেক পাড় দেখতে চায়। লেকে হাঁস ভাসছে, জিজ্ঞেস করছে আম্মু কি ভাসছে? কেন ভাসছে? কিভাবে ভাসছে? ছোট মনে নানা প্রশ্ন। সিটি করপোরেশন এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সমন্বয় করলে লেক পাড়ের অংশটি হতে পারতো সবচেয়ে আধুনিক এবং আকর্ষণীয়। কারণ, লেকেরে দায়িত্বে রাজউক।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা ঢাকা মেইলকে বলেন, গুলশানের ফজলে রাব্বি পার্কের ডিজাইন আমরা বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ারদের মাধ্যমে করিয়েছি। যে কারণে পার্কটিতে বুয়েটের যে সাজেশন এসেছে, তাই কাজ করা হয়েছে। কনসালটেন্টরা আমাদের যেভাবে সাজেশন দিয়েছে, আমাদের তার বাহিরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। এ নিয়ে বলবো, কিছু কিছু জিনিস নগরবাসীর পছন্দ হবে না।
প্রধান নির্বাহী বলেন, এখন কেউ কেউ বলছেন আমরা কাজ না শুরু করলেই ভালো ছিল। উন্নয়ন কাজ করে আরও নষ্ট হয়েছে। আমরা নষ্ট করেছি নাকি ভালো করেছি তা বলার আগে বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ারদের সামনে দাঁড় করানো দরকার। তারা বলবেন কি বানাইছেন এগুলো? আমার সিটি করপোরেশনের কয়েক কোটি টাকা এ নিয়ে ইতোমধ্যে খরচ হয়েছে। তারা এটা করছে, সেটা করছে। এক ধরনের ওয়াল (দেয়াল) ছিল তা ভেঙ্গেছে। একধরনের গেট ছিল তা ভেঙ্গেছে। সেইম গেট আবার নতুন ভাবে করতে হয়েছে। সেখানে টাকা খরচ হয়েছে। বুয়েটের কনসালটেন্টদের ফিস দিতে হয়েছে। এ নিয়ে এত এত প্রশ্ন। আমরা চিন্তা করছি গণমাধ্যমের সামনে বুয়েটের প্রফেসরদের দাঁড় করাবো, তারা বলবেন এটা কি নির্মাণ করেছেন।
পার্ক বর্তমানে যে রূপ পেয়েছে এমন পার্ক সিটি করপোরেশন চায়নি জানিয়ে সেলিম রেজা বলেন, এটা আমরা বানাইতে চাইনি। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা বানাইলে আরও তিন বছর আগেই হয়ে যেত। বুয়েটের লোকজন কাজ আটকিয়ে বলে, বিদেশ থেকে এটা আনেন, ওটা আনেন, হেন আনেন, তেন আনেন। বর্তমানে পার্কের ড্রেনেজ করা হয়েছে। এটা আহামরি তেমন কিছুই না। এটা করতে গিয়ে তিনবার জিনিসগুলো পরিবর্তন করতে হয়েছে।
উল্লেখ্য, পার্কটির অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স এম আর কনস্ট্রাকশন। প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয় ১১ কোটি ৫২ লাখ ৭২ হাজার টাকা। ২০২১ সালের এপ্রিলে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
ডিএইচডি/এমএইচটি