জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
১০ জুলাই ২০২৩, ১০:৩২ পিএম
পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার গিঞ্জি পরিবেশে থাকেন শাহিনুর আক্তার। কাজ করেন ইন্দিরা রোডের একটি বাসায়। এডিস মশা বা ডেঙ্গুর জন্য উত্তর সিটি কর্পোরেশন এই এলাকাকে হটস্পট হিসেবে বিবেচনা করলেও এসব বিষয় নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই শাহিনুর আক্তারের।
শাহিনুরের মতো ওই এলাকায় বসবাস করা আব্দুল আজিজের একটি ছোট পান-সিগারেটের দোকান আছে। কথা প্রসঙ্গে জানান, মশা নিয়ে ভাবার মতো সময় নেই তার। অথচ যেখানে বসে পান বিক্রি করেন তার পাশের ড্রেনেই থাকতে পারে মশার প্রজননস্থল।
শুধু শাহিনুর বা আব্দুল আজিজই নয়, রাজধানীর খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষের বেশিরভাগেরিই এডিস মশা বা ডেঙ্গু নিয়ে বিশেষ ভাবনা নেই।
এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহিনুর আক্তার বলেন, স্যার আমরা গরিব মানুষ, আমাগো রক্ত মশার ভালো লাগব না। আগে বিশ্বাস করতাম না মশার কামড়ে মানুষ মারা যায়। কয়েকদিন আগে পান্থপথের পরিচিত একজন ডেঙ্গুতে মরছে। তখন একটু বিশ্বাস করছি।
কারওয়ান বাজারে গাড়ি থেকে কাঁচামাল নামানোর শ্রমিক আজাহার উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, রাতভর কাম করি। মশা কামড়ানোর সময়ই পায় না। আর দিনের বেলায় ঘুমাই। ফ্যান চলে। মশা যদি কামড়ায়ও টের পাওয়ার সময় নাই। একদিন কাম না করলে পেটে ভাত যায় না ভাই। করোনা আইছিল দেশে, তারপরও বইসা থাকতে পারি নাই।
কারওয়ান বাজারে মাছ কাটার শ্রমিক আলী হোসেন কিছুদিন আগে অসুস্থ ছিলেন। তবুও কাজ বাদ দিতে পারেননি। আলী হোসেনের স্ত্রী বলেন, তিনদিনের বেশি জ্বর ছিল, ডেঙ্গু কিনা জানি না। জ্বর পুরোপুরি কমে নাই, কিন্তু উনি কাম বাদ দেন নাই। পরে হাসপাতালে গেছে। আমরা থাকি রেললাইনের সাথেই। মশা তো থাকবোই। আর মশার কামড়ে জ্বর হয়—এতো চিন্তার কি আছে!
তেজতুরী এলাকায় একটি টিনশেড ঘরে থাকেন রিকশাচালক ইব্রাহিম হোসেন। তিনি বলেন, ঈদের আগে আমার ছেলের এই রোগ হইছিল। তখন কাজকাম বাদ দিয়া কয়দিন হাসপাতালে ছিলাম। কি কি পরীক্ষা করলো, ভর্তি করলো। পরে শুনলাম মশার কামড়ে ডেঙ্গু হইছে। সুস্থ হয়ে ফেরার পর মশারি কিনছি সবার জন্য। একটা বাড়তি খরচ করাইছে এই মশা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, দৈনিক উপার্জন করা ব্যক্তি, ছিন্নমূল মানুষ, তৃণমূলের মানুষরা জ্বর বা ডেঙ্গুর লক্ষণ হলেও প্রাথমিকভাবে কেয়ার করছেন না। বেঁচে থাকার সংগ্রামই তাদের কাছে মুখ্য বিষয়। দরিদ্র মানুষ তখনই গুরুত্ব দেয় যখন সে আর পারছে না বা গুরুতর অবস্থা হয়।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, আমরা পূর্ব সতর্কতা হিসেবে কিছু করতে পারছি না। যখন অবস্থা গুরুতর হয় তখনই আমরা নড়েচড়ে বসি। তিনি বলেন, প্রান্তিক অর্থনৈতিক মানুষ যাদের অনেকের চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে এটি সরকারকে বহন করতে হবে। অর্থ নেই বলে যেন একটা মানুষ মারা না যায়।
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ও সচেতনতা নিয়ে অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, জনস্বাস্থ্য বিষয়ে জনসম্পৃক্ত খুব জরুরি। আমরা দেখি দুই মেয়র বিভিন্ন এলাকায় গেলে ওয়ার্ড কাউন্সিলররা দেখানোর জন্য, ছবি উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাউন্সিলরদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যে ওয়ার্ড হটস্পট হবে সেই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। মুগদা মান্ডার অবস্থা খুবই খারাপ। এখনো পিকটাইম আসেনাই অথচ তার আগেই হাসপাতালে ১২ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন। মূল সময় আসার আগেই এই অবস্থা।
তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালের ধারণ ক্ষমতা বা প্রস্তুতি নেই। প্রান্তিক দরিদ্র মানুষদের ব্যয় সরকার বহন করবে সেই ধরনের আর্থিক বাজেটও নেই। আমাদের যা আছে সেটি হলো মশা নিধনের জন্য বরাদ্দ। সিটি কর্পোরেশন এই বরাদ্দ আসলে কি করে? সিটি কর্পোরেশন যা বলে সে কাজটি যথাযথভাবে হলে মশা এত বংশ বিস্তার করার কথা না। তারা যা বলে আর মশার যে উপস্থিতি— দুইয়ের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছি না। এর ভুক্তভোগী আরও বেশি আমাদের দেশের খেটে খাওয়া মানুষ, প্রান্তিক মানুষ। যে মানুষটির কাছে খাওয়ার চিন্তাই মুখ্য, তার কাছে কোথায় ঘুমালেন, মশা বা কে কামড়াল সেটি দেখার সময়ও নেই। আবার ফগার মেশিনের ব্যবহারও কিন্তু দরিদ্র এলাকায় কমই দেখা যায়।
সচেতন কিভাবে করা যায় সে বিষয়ে তিনি বলেন, দ্রুত মানুষকে সচেতন করবে এমন কৌশল নিতে হবে। দ্রুত সচেতন করতে গণমাধ্যমগুলোতে প্রচার বাড়াতে হবে। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের এলাকায় উপস্থিতি বাড়াতে হবে। কাউন্সিলরদের জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। সচেতনতার আরেকটি মাধ্যম বড় জমায়েত। মসজিদ, বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে। এভাবে দ্রুত সচেতন করা যাবে। এখনেও একটা শ্রেণির মধ্যে এই ধারণা আছে- মশা কামড়ালে আর কি হবে, এই ধারণা থেকে বের করে আনতে হবে।
ডব্লিউএইচ