লাইফস্টাইল ডেস্ক
১৪ মে ২০২৩, ০১:২৬ পিএম
গত এক যুগ ধরে মা আমাদের সঙ্গে বসবাস করেন। তার আগ পর্যন্ত নিজের চাকরিক্ষেত্র থেকে পাওয়া সরকারি ফ্ল্যাটেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। একলা থাকতেন, ঘরের কাজের জন্য একজন সহকারী রাখতেন শুধু। একাত্তরে মাত্র বাইশ বছর বয়স ছিল তার। সাথে তিন বছরের কন্যা। মা, ভাইবোন নিয়ে বড় এক সংসারের দায়িত্ব তুলে নিতে হয়েছিল মাস্টার্স পাশ করবার পরপরই। দিশেহারা সময় তাকে এক ঝলকে বৃদ্ধ করে তুলেছিল।
অথচ আমি যখন মায়ের পেটে মোটে ছয়মাস, অনেক গরমে মা শুধু মুখ ফুটে বলেছিলেন, ‘আলতু ফ্রিজের ঠান্ডা জল খেতে ইচ্ছে করে। বিকেলে বের হয়ে কার কার থেকে টাকা ধার করে নতুন ফ্রিজ কিনে নিয়ে এনেছিলেন বাবা’।

আমাদের বাসায় বাবার পছন্দের খাবার মা কখনই রান্না করতেন না, এখনও করেন না। মায়ের হাতে সবচেয়ে মজাদার পদগুলো জীবনেও খাওয়া হবে না জেনেছিলাম, সেই ছেলেবেলা থেকেই। এবং তার এমন ধরনের উন্নাসিকতার বিরুদ্ধে অবাধ্য হতে অভ্যস্ত হয়েছিলাম তখন থেকেই। এই জীবনে কোনোদিনও নিজের হাতে লিচু ছিলে মুখে দেইনি। ফ্রিজ খুলতেই বক্স ভর্তি ঠান্ডা লিচু পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তাকে।
পৃথিবী এদিক-ওদিক হয়ে গেলেও সকালের পাউরুটি টোস্ট মাকেই করতে হবে। পেঁপে আর তরমুজের জুস, মা ছাড়া হয় না কখনও। দেশি মুরগীর টলটলে পাতলা ঝোল আর হাত ধোয়া জলে ছোট মাছের চচ্চড়ি, আম পেঁয়াজু আরও কত কী যে আছে আমার অবাধ্য আবদারের তালিকায় তা লিখে শেষ করা মুশকিল।

খাবারের সাথে ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে। জন্ম হবার পর জীবনের প্রথম খাবার মায়ের থেকে পায় শিশুরা। জন্মদাত্রী মায়ের সাথে নতুন আরেক বন্ধনে আবারও জড়াই আমরা। মায়ের হাতের খাবার এই পৃথিবীর সেরা শেফের সেরা ডিশকেও হার মানায়। কারও মৃত্যু পূর্ববর্তী সময়ে সে যা খেতে চায়, তাই খেতে দেয় স্বজনেরা। মৃত্যু হলে সবচেয়ে আগে তার পছন্দের খাবারের কথা মনে করে আপনজনেরা।
আমার বাবা তার মাকে হারিয়েছিলেন অনেক ছোট থাকতে। বেঁচে থাকবার সময়গুলোতে, বিশেষ করে বিয়ের পর আমার নানু আর মায়ের হাতের রান্না খেতেন। তিনি নিখোঁজ হবার পর নানু বা মা কখনই তার প্রিয় খাবার রাঁধতেন না।
আমার জীবন সঙ্গী টিপু। মাকে হারিয়েছে সে তার মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার সময়। যখন থেকে আমার মা আমাদের বাড়িতে উঠে আসলেন তখন থেকেই ধীরে ধীরে টিপুর মা হয়ে উঠলেন। ক্রমশ আমার অবাধ্য হবার তালিকায় আরও অনেক কিছু যোগ হলো। একসময় আমি অত্যাচারী কন্যা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে বিশাল শান্তি যোগ করতে পেরেছিলাম প্রতিদিনের জীবনযাপনে। ডাল বাগার দিয়ে দাও, নাহলে খাব না। সাবুদানার পায়েস বানাও, সেই ছেলেবেলার মতনই যেন স্বাদ হয়। শাক বেছে না দিলে রাঁধবই না। গরম ভাত পাতে বেড়ে দাও। বড় মাছের টুকরোটা খাও। আরও কত কী, শেষ নেই।

মায়ের বয়স বাড়ছে, সাথে আমাদেরও। আমরা তিনজন বৃদ্ধ হচ্ছি একসাথে। মায়ের ভালো নাম সারা। এই সারা, সারা ঘরময়, সারাক্ষণ সারাময় করে রাখেন। আমার জ্বালাতনে মাঝে মাঝে বলে উঠেন, ‘আমি মরে গেলে কে তোমাকে ফল ছিলে খাওয়াবে?’ আমার সোজা উত্তর, ‘তখন আর খাবো না’। আবারও প্রশ্ন ছুড়ে দেই তার দিকে, ‘আমি মরে গেলে কার জন্য প্রতিদিন ফল ছিলে রাখবে বলো?’ মা চুপ হয়ে অন্য কাজে চলে যান, অন্য দিকে।
আধেক হারানোর বেদনা ছাপিয়ে পুরো হারাতে কে চায়? মা, কখনই নয়। মা তো মা।
লেখক: শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা
এনএম