লাইফস্টাইল ডেস্ক
২১ অক্টোবর ২০২২, ০৩:৫৫ পিএম
প্রথমবারের মতো কুমিল্লা যাই ২০১৯ সালে। বিভিন্ন কারণে কুমিল্লা একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ প্রতিটি বিষয়ে জেলাটি সুপরিচিত দেশ বিদেশের মানুষের কাছে। ঢাকার নিকটবর্তী হওয়ায় খুব বেশি সময় লাগেনি যেতে। যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল এই শহরে বসবাসরত গুণীজন প্রফেসর জোহরা আনিসের সঙ্গে দেখা করা। শিক্ষাবিদ ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনের সংগঠক হিসেবে তিনি পরিচিত।
আমি যখন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে বাস থেকে নামি তখন বেশ রাত। থাকার বন্দবস্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র খালেদ ভাইয়ের বাসায়। পরের দিন সকালে আমি কুমিল্লা এসেছি জানিয়ে প্রফেসর জোহরা আনিসের কাছ থেকে দেখা করার সময় জেনে নিই। তিনি অনেকগুলো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় প্রতিদিনই প্রোগ্রাম থাকে। আমি দেখা করতে চাওয়ায় সন্ধ্যার সময় দিলেন।
প্রথমবার দেখা হওয়ার আগেই আমি বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। তিনি আমার শিক্ষক ড. রাশেদা রওনক খানের মা। আমার শিক্ষকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকে তার পরিবার সম্পর্কে আমি জানতে থাকি। এক কথায় বলা যায় মানবিকতার সর্বোত্তম উদাহরণ এই পরিবার।
প্রফেসর জোহরা আনিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা ছিল। কথা বলে এমনটাই মনে হয়েছে আমার। তার তিন সন্তানের দুই জন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছেন। দুর্বলতার মূল কারণ হয়তো এটাই। আমার সঙ্গে কথা হলেই তিনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প বলতেন। ফোন দিয়ে আমার পরিচয় দিলে তিনি প্রথমেই চমৎকার একটি হাসি দিয়ে বলতেন ‘ও তুমি রওনকের ছাত্র, তা কেমন আছো তুমি’।
সারাদিন কুমিল্লা শহর ঘুরে সন্ধ্যা নামার একটু পরে আমারা হাজির হই প্রফেসর জোহরা আনিসের বাসায়। আমরা এসেছি দেখে তিনি ভীষণ খুশি হন। আমরা যে রুমে বসে কথা বলছিলাম সেটা ছবিতে ভরপুর। আমার কাছে মনে হয়েছিল এটা একটা ছবির যাদুঘর। পরিবারের সবার ছবি এখানে আছে। তবে আমার শিক্ষক ড. রাশেদা রওনক খানের ছবি বেশি চোখে পড়েছে। আমি প্রতিটা ছবি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছিলাম আর এইসব ছবির পেছনের গল্প প্রফেসর জোহরা আনিস আমাদের বলছিলেন।
গল্পের মাঝে তার একমাত্র ছেলে কুমিল্লার বিখ্যাত ছাত্র ডা. আরিফ মোর্শেদ খান এবং বৌমা ডা. আতিশা রাব্বির সঙ্গে পরিচয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, তৎকালীন ছাত্র রাজনীতির, মুক্তিযুদ্ধ, নিজের পেশা জীবন, বিভিন্ন সংগঠন নিয়ে কত আলাপ হলো আমাদের। একটা মানুষ কতটা মানবিক, ধৈর্যশীল, দেশপ্রেমী হতে পারে তাঁর সাথে দেখা না হলে হয়তো অনেক কিছু অজানা থেকে যেতো। তার সমাজ ও দেশ নিয়ে ভাবনা, সন্তানদের মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সহ হাজারো ভালো কাজের জন্য তিনি ‘রত্ন গর্ভা মা ও বেগম রোকেয়া পদক’ এ ভূষিত হয়েছিলেন।
কুমিল্লা থেকে আসার পরে মাঝে মাঝে ফোন কথা বলতাম। আমাকে স্নেহ করতেন অনেক। সর্বশেষ কথা হয় গত বছর তার জন্মদিনে। রাতে শুভেচ্ছা জানাতে ফোন দিলে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। অনেক কথা হয় সেদিন। এটাই ছিল আমাদের শেষ কথা। এরপর তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যান। পরে চিকিৎসারত অবস্থায় গত বছর আজকের দিনে আল্লাহর মেহমান হিসাবে পরকালের উদ্দেশ্য রওনা হন।
পবিত্র কোরআনে আছে ‘প্রতিটি জীবকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই আমাদের। তবে ভালো কর্মকাণ্ডের কারণে হাজারো বছর বেঁচে থাকা যায় মানুষের মাঝে। প্রফেসর জোহরা আনিস এমনই একজন। তার নিজের ও পরিবারের সঙ্গে আমার স্মৃতিগুলো অমলিন হয়ে থাকবে আজীবন।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, জাবি।
এনএম