images

লাইফস্টাইল

রৌদ্র-মেঘের শামিয়ানায় প্রকৃতিতে ‘শরৎ’ রাজত্ব

নিশীতা মিতু

০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:০৩ এএম

গতকাল সকালে আকাশ ছিল কালো মেঘে ঢাকা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর হালকা হাওয়ার স্পন্দন আনমনা করে তুলেছিল পথিককে। আজ আবার প্রকৃতি দেখাচ্ছে ভিন্ন রূপ। রৌদ্রতাপে পুড়ছে গাছ-গাছালি থেকে শুরু করে জনমানব। কালো মেঘকে হটিয়ে আকাশে শামিয়ানা বিছিয়েছে সাদা মেঘের দল। কখনো প্রখর রোদ, কখনো মেঘ আবার কখনো বৃষ্টি। প্রকৃতির এমন আনমনা স্বভাবই জানান দেয় বর্তমানে শরতের রাজত্ব চলছে। 

এ বছর শরৎ কিছুটা নীরবেই এসেছে বলা চলে। ইতোমধ্যেই পেরিয়ে গেছে ভাদ্র মাসের ২১ দিন। তবে অল্প অল্প করে নিজের রূপ প্রকাশ করছে শরৎ কন্যা। তাইতো জানালার গ্রিল কিংবা চলন্ত বাসের জানালায় চোখ রেখে আকাশে মেঘের নাচ দেখে মন গেয়ে ওঠে- ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা..’

shorotস্নিগ্ধ আর সতেজ এক ঋতু শরৎ। বর্ষার অবিরত কান্না থামিয়ে প্রকৃতিতে আগমন ঘটায় সে। একই সঙ্গে জানান দেয়, এইতো কদিন পর সোনালি ফসলে ভরে উঠবে মাঠ। স্বচ্ছ আকাশ, নানা ফুলের শোভা আর শস্যের শ্যামলতা নিয়ে নিজের সৌন্দর্য তুলে ধরে শরৎ। 

লুকোচুরি খেলা বোধহয় শরতের প্রিয় ভীষণ। তাই রোদ আর ছায়ায় মধ্যে লুকোচুরি খেলা চলতে থাকে সারাদিন। কখনো সাহসী সূর্য দেখায় নিজের তেজ। আবার পরক্ষণেই দলছুট সাদা মেঘ ঢেকে দেয় তাকে। বুক পেতে আলো-আঁধারের এই খেলা উপভোগ করে আসমানী আকাশ। ফসল ভরা ক্ষেতে এসময় দোলা কাটে দখিনা বাতাস। রাতের বেলায় জোছনা জ্বালায় আলোর প্রদীপ। মায়াবী শরত তার চঞ্চলতা দিয়ে কেড়ে নেয় প্রকৃতি আর প্রাণের মন। 

shorotশরত মানেই নানা ফুলের সমাহার। বিশেষ করে শিউলি আর কাশফুলের কথা না বললেই নয়। শরতের সকালে নিজেকে লুটিয়ে দেয় শিউলি। সাদা রঙের শরীর আর কমলা বোটার এই ফুলের সুবাসে মাতাল হয় মন-প্রাণ। বালুর চরগুলো হালকা আর লোমশ কাশফুলে ভরে উঠে এসময়। এ যেন প্রকৃতির এক সাদা গালিচা।

এখানেই শেষ নয়। শরতে আরও ফোটে- হিমঝুরি, গগনশিরীষ, ছাতিম, পাখিফুল, পান্থপাদপ, বকফুল, মিনজিরি, কলিয়েন্ড্রা। শরতের সৌন্দর্য আরেকটু বাড়াতে এই দলে যুক্ত হয় শাপলা, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কামিনী, মালতি, মল্লিকা, মাধবি, ছাতিম, দোলনচাঁপা, বেলি, জারুল, নয়নতারা, ধুতরা, ঝিঙে, জয়ন্ত্রী, রাধাচূড়া, স্থল পদ্মসহ নানা রকমের ফুল।

shorotঋতুর রাজা বসন্ত এ কথা তো জানেন। রাণীর উপাধি কিন্তু ছিনিয়ে নিয়েছে শরৎ। এই ঋতুকে ঘিরে কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্য রচনা হয়েছে অগণিত। শরতকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন বাংলার বহু কবি। কবিতার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন শরতের অপরূপ সৌন্দর্য।

কবিগুরুর ভাষায়- ‘তুলি মেঘভার আকাশে তোমার- করেছ সুনীল বরণী/ শিশির ছিটায়ে করেছ শীতল/ তোমার শ্যামল ধরণী।’ প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের চোখে শরৎ দেখা দিয়েছে প্রেমিকা রূপে। প্রেম-দ্রোহের কবি নজরুলকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল শরতের প্রকৃতি। শিউলি ফুলে মুগ্ধ হয়ে তিনি লিখেছেন- ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে/ এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে।’

shorotশরত এলেই চারদিকে শুরু হয় সাজ সাজ রব। ফুলের সুবাসে, পাখির কুজনে মুখরিত হয় পল্লীগ্রামের মাঠ-ঘাট জনপদ। এই ঋতুতে হিন্দু সম্প্রদায়ের অপেক্ষার পালা শুরু হয়। শারদীয় দুর্গাপূজার শারদীয় শব্দের আগমনই ঘটেছে শরত থেকে। এই শরতেই দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা কৈলাশ ছেড়ে মর্তে আসেন ভক্তদের কাছে। আর তাই নদীর পাড়ে কাশফুল যেন উড়ে উড়ে বলে যায়- শরৎ এসেছে, পুজো আসছে।

শরতের সঙ্গে তারুণ্যের সম্পর্কটা বেশ পুরনো। সাদা, আকাশী, নীল রঙের পোশাকের আধিক্য এ সময় বেশি চোখে পড়ে। হয়ত তরুণ-তরুণীরা নিজেদের এক খণ্ড আকাশ বা মেঘ হিসেবে সাজিয়ে ঘুরে বেড়াতে চায় সাদা কাশফুলের বনে। 

shorotযুগল থেকে শুরু করে পরিবার, স্বজন, বন্ধু— প্রায় সবাইকেই শরতের এই সময়টাতে নদীর পাড়ে কাশবনগুলোতে ঘুরতে দেখা যায়। তরুণীদের অনেকেই নীল শাড়ি, সাদা কাঁচের চুড়ি আর লাল টিপে বাঙালি রমণী হয়ে উঠেন, তরুণের অনেকেই গায়ে জড়ায় নীল পাঞ্জাবী।

শিউলি তলার কোমল অভ্যর্থনায় দিন শুরু করে শরৎ। দিন জুড়ে রোদ, বৃষ্টি আর মেঘের খেলা চালিয়ে যায়। বিকেলে প্রশান্তি দেয় গোধূলির আলোয়। রাতে বিলায় জোছনা। সব মিলিয়ে ঋতুর রাণী হিসেবে নিজের সবটা উজাড় করে দেয় শরৎ। 

এনএম