নিশীতা মিতু
১১ আগস্ট ২০২২, ০২:৪৩ পিএম
মানুষ যা চায় তা সবসময় পায় না। বিশেষ করে পড়াশোনার ক্ষেত্রে মা-বাবার ইচ্ছেটাই যেন প্রাধান্য পায় বেশি। এই যেমন সুমাইয়া সুলতানা কনিকার শখ ছিল ফ্যাশন ডিজাইনার হবে। কিন্তু মা-বাবা ভর্তি করিয়ে দিলেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। বাইনারির ০ আর ১ এর ফ্রেম কখনো বেঁধে রাখতে পারেনি কনিকাকে। কাপড়ে কাটাকুটি না করতে পারলেও আঁকিবুঁকি করেছেন ঠিকই। নিজের মনে লুকিয়ে রাখা সুপ্ত বাসনাকে বাস্তবতার রূপ দিয়েছেন। হয়েছেন উদ্যোক্তা।
বর্তমানে মানিকগঞ্জে থাকলেও কনিকার জন্ম ঢাকাতে। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে কলোনিতে বড় হয়েছেন তিনি। জীবনের অন্যতম সুন্দর মুহূর্তগুলো সেখানেই কাটিয়েছেন বলে মনে করেন কনিকা। ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘ঢাকার খুব কম শিশুই আছে যারা এত সুন্দর সময় কাটাতে পারছে। এমন কিছু নেই যা আমরা ওই কলোনিতে করিনি। বউচি, গোল্লাছুট খেলা থেকে শুরু করে গাছের ফলও চুরি করে খেয়েছি। প্রতিবছর ফাইনাল পরীক্ষা শেষে সব বাচ্চারা মিলে পিকনিক করতাম। খুব আনন্দের ছিল দিনগুলো।’
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক শেষ করেছেন কনিকা। তবে এই পড়াশোনা তাকে টানে না। কিছুটা অভিমানের স্বরে কনিকা বলেন, ‘ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। একদিন অনেক বড় ফ্যাশন ডিজাইনার হবো, সবাই আমাকে চিনবে এমন স্বপ্ন ছিল। ফ্যামিলি আর সমাজের ভারে তা আর হয়ে উঠেনি। যেদিন সিএসইতে আব্বু ভর্তি করে দিয়ে আসলেন, সারারাত কান্না করেছিলাম। যত আর্টের খাতা, পেন্সিল ছিল সব পুড়িয়ে ফেলছিলাম। মানুষ মনে হয় কাউকে ভালোবেসেও এত কান্না করে না আমি সেদিন যতটা কান্না করেছিলাম। তারপর বহুবছর আমি আর আর্টের জন্য খাতা পেন্সিল ধরিনি।’
বর্তমানে অবশ্য রঙ তুলি আর আঁকাআঁকি নিয়ে কাজ করেন কনিকা। অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘বন্দীবাক্স’ এর কর্ণধার তিনি। হ্যান্ড পেইন্টের গয়না, কুর্তি, পাঞ্জাবি, শিশুদের পোশাক ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন এই তরুণী। বন্দীবাক্সের যাত্রা শুরু হয় ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই থেকে।
ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন, এরপর সিএসইতে ভর্তি হয়ে আর্টের খাতা পুড়িয়ে ফেলা। তাহলে কী করে আবার এ জগতে ফিরলেন? জানতে চাইলে কনিকা বলেন, ‘অনলাইন ব্যবসায় আসার গল্পটা বাকিদের থেকে একটু অদ্ভুতই হয়তো আমার ক্ষেত্রে। ইউনিক জিনিস খুব ভাল্লাগে পরতে বা বানাতে। তো ২০১৯ এর দিকে কাঠের গয়নার চল চলছিল। সেগুলো এত ভাল্লাগে দেখে। একটা পেইজ থেকে শুধু দুইটা আংটি কিনি ২৪০ টাকা দিয়ে। একে তো দামটা বেশি, তার ওপর রঙটা ঠিকমতো ব্লেন্ড করেনি। তখন একটু আফসোসই হলো যে ইসস এগুলো আমি কী সুন্দর কালার করতে পারতাম।’
‘পরিচিত ছোট বোন একদিন হুট করে বাসায় এসে বলে আপু দেখো কী নিয়ে আসছি। কিছু কাঠের রিং বেইজ নিয়ে আসে ও। আমার কাছে কিছু রঙ ছিল যেহেতু একসময় রঙ-তুলি নিয়ে বসে থাকতাম। খুশি মনে কয়েকবছর পর রঙ আর তুলি হাতে নিই, কাঠের টুকরো রাঙাই। প্রথমদিকে নিজে পরার জন্যই গয়না তৈরি করতাম। পরে সেই ছোটবোন পেজ খুলে ছবি আপলোড করতে বলে। এই পেইজ খোলা থেকে শুরু করে স্বপ্ন দেখানো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সাহস দিছে আমার বেস্টফ্রেন্ড। ও না থাকলে আমার এই সাহস করে কখনো পেইজ খোলাই হতো না হয়তো। কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবদান যদি এই পেইজের থাকে সেটা আমার ওই ছোট বোনের। ওই এই পেইজের জিনিস আনা থেকে শুরু করে আমার পেইজের প্রোডাক্ট এর ছবি তোলা, পরিচিত বাড়ানো, ডেলিভারি দেওয়া সব কাজ একা করেছে।’- যোগ করেন কনিকা।
নিজের জমানো ১ হাজার টাকা আর পরিচিত সেই ছোট বোন থেকে ১ হাজার টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন কনিকা। প্রথম বিক্রীত পণ্য ছিল একটি সুতার মালা। একদমই ভিন্ন ছিল মালাটি। ভেঙে যাওয়া কিছু জিনিসকে জড়ো করে মালাটি বানিয়েছিলেন তিনি। এরপর আরও কিছু মালা বানান। এই তালিকায় যোগ করেন আংটি। এভাবেই চলতে থাকে ব্যবসা।
হ্যান্ড পেইন্টের গয়নার ক্ষেত্রে এই উদ্যোক্তা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন রঙকে। সঠিক কম্বিনেশন, সঠিক ব্লেন্ডিংয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেন নকশা। চেষ্টা করেন অন্যদের থেকে ভিন্ন কায়দায় গয়না তৈরি করতে।
ব্যবসায়িক জীবনের তিন বছর পার করছেন এই উদ্যোক্তা। প্রথম দুই বছর পরিবারের কোনো সাহায্য পাননি বললেই চলে। এই ধরনের কাজে তাদের না ছিল না। আবার খুব যে পছন্দ করতেন তেমনটাও না। অবশ্য এখন মোটামুটি সহযোগিতা পাওয়া যায় তাদের থেকে।
ক্রেতাদের সঙ্গে কনিকার সম্পর্ক বেশ ভালো। দুই একটি খারাপ অভিজ্ঞতা থাকলেও সেগুলোকে মনে রাখেন না তিনি। বরং সুখস্মৃতিটুকু সঙ্গী করে সামনের পথে আগাতে চান। ক্রেতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে কনিকা বলেন, ‘একবার এক মেয়ে হুট করে টিএসসিতে দেখেই এসে জড়িয়ে ধরে বলে আপু তুমি বন্দীবাক্সের কনিকা আপু না? তোমার কাছ থেকে আমি অনেক প্রোডাক্ট নিয়েছি। সেদিন এত ভালো লেগেছিল!’
‘আরেকবার এক মেয়ে একটি ভিডিও দেখে আমার বাসার এড্রেস চিনে। ওর বাসাও আমার বাসার কাছেই ছিল তাই। সে আর তার বোন একটা মেলায় আমার প্রোডাক্ট দেখে এত পছন্দ করেছিল পরে আমাকে দেখতে বাসার নিচে চলে এসেছিল। ছোট ছোট ভালোবাসাগুলো অদ্ভুত সুন্দর স্মৃতি।’- যোগ করেন কনিকা
ব্যবসায়িক জীবনে হঠাৎ বড় বাধা এসে হাজির হয়। দুর্ঘটনায় হাত ভেঙে যায় কনিকার। বন্ধ হয়ে যায় সব কাজ। সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কনিকা বলেন, ‘২০১৯ সালের কথা। ব্যবসা মোটামুটি ভালোই চলছিল। দেশের বাইরে থেকে বেশ বড় একটি কাজের অর্ডার আসে। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার পথে দুর্ঘটনা। ডান হাত ভেঙে যায় আমার। অপারেশন করতে হয়। ডাক্তার জানান এক বছর কাজ করতে পারবো না। প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকার অর্ডার ক্যান্সেল করে দিতে হয়।’
বাম হাত দিয়ে টুকটাক কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই। তবে আগের অবস্থানে আর ব্যবসাকে নিতে পারছিলেন না তিনি। ভেবেছিলেন থেকে যাবেন। কিন্তু রঙ তুলির নেশা ছাড়তে পারছিলেন না। ভাঙা হাতেই শুরু করলেন কাজ করা।
কনিকা বলেন, ‘কিছুক্ষণ কাজ করলেই হাত ভয়াবহ ব্যথা করতো, কাঁপত। কান্না করতাম যে আর হয়তো ওইভাবে কখনো পারবো না। তারপরও চেষ্টা করতেই থাকলাম। একটা সময় যেয়ে পেরে উঠলাম। এখন আমি আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করি। কিন্তু হাত কাজের পর প্রচণ্ড ব্যথাও করে।’
এরই মধ্যে পুরো পরিবার চলে গেলেন মানিকগঞ্জ। ব্যবসাটাকে শত চেষ্টা করেও আগের মতো সচল আর করতে পারছিলেন না কনিকা। মানিকগঞ্জেই পরিচিতি বাড়াতে শুরু করলেন। একটু গুছিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ভাগ্য যেন বড্ড নিদারুণ। এবার কনিকার সঙ্গী হলো করোনা। তবে দমে যাওয়ার মেয়ে তিনি নন। যতবার ভেঙে পড়েছেন, ততবার নতুন শক্তিতে কাজ শুরু করেছেন।
একদিন বন্দীবাক্সের নাম সবাই জানবেন। সবাই চিনবে বন্দীবাক্স পণ্য। একদিন ভিড় জমবে বন্দীবাক্স শপ- চোখের আঙিনায় এমন স্বপ্ন নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন কনিকা। একদিন সফল উদ্যোক্তার খাতায় নাম লেখাবেন এমনটাই তার চাওয়া।
এনএম