ফিচার ডেস্ক
২৭ আগস্ট ২০২৫, ১১:৩৬ এএম
ছোটবেলায় আমার কোঁকড়ানো চুল দেখে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আবদুল রাজ্জাক স্যার আমাকে ডাকতেন ‘নজরুল’ বলে। সেই ডাক আজও আমার মনে গভীরভাবে বাজে। কারণ কবিতা আবৃত্তি আমার জীবনের অঙ্গ, আর আমার অধিকাংশ পুরস্কারও কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার জন্য। ব্যক্তিগত সেই স্মৃতি যেন জাতীয় কবির সঙ্গে এক অদৃশ্য সেতুবন্ধন গড়ে দিয়েছে।
আজ ১২ ভাদ্র, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি এক অমর নাম, এক অভিনব প্রতীক। তিনি কেবল ‘বিদ্রোহী কবি’ নন; গীতিকার, সুরকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সম্পাদক, সৈনিক ও অভিনয় শিল্পী হিসেবেও অসাধারণ ছিলেন। জীবনভর বঞ্চিত থেকেছেন প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে, পেয়েছেন দুঃখ-দুর্দশা, অসুস্থতা এবং নির্বাক নিঃসঙ্গতার জীবন।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্ম নেওয়া নজরুল, দরিদ্র পরিবারে বড় হয়েছেন। জীবনের শুরুতেই হারিয়েছিলেন বাবা। জীবিকার তাগিদে কখনো রুটি-রুজির জন্য কাজ করেছেন, কখনো লেটো দলের গানে অংশ নিয়েছেন। এখান থেকেই গান, কবিতা এবং অভিনয়ের বীজ তার মননে গেঁথে যায়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে পেয়েছিলেন শৃঙ্খলা, সাহস এবং বিশ্বদৃষ্টির অভিজ্ঞতা— যা তাঁর কবিতায় যুদ্ধ ও সংগ্রামের ভাষা হিসেবে ফুটে উঠেছে।

১৯২২ সালে প্রকাশিত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ তাকে রাতারাতি পরিচিতি এনে দেয়। এই কবিতায় শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দিয়ে মানবমুক্তির আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রচণ্ড ঝড় ও স্নিগ্ধ ভালোবাসার এই মিলনে নজরুল পেয়েছেন এক অনন্য শিল্পী পরিচয়। তাঁর কবিতা শুধু সাহিত্যিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং যুগান্তকারী শক্তির জন্যও অনন্য।
কাজী নজরুল ইসলামের গানের ভাণ্ডার অসীম—প্রায় চার হাজারের বেশি রচনা, যার অনেকটাই নিজের সুরে গাওয়া। তাঁর সঙ্গীতে রয়েছে ভক্তি, প্রেম, দ্রোহ, মানবতা, সাম্যবাদ। ইসলামি গান থেকে শুরু করে শ্যামাসংগীত, কীর্তন, কাব্যগীতি— সব ধারাতে তিনি অবাধ বিচরণ করেছেন। “চল চল চল” আজও প্রেরণার সঙ্গীত; পাশাপাশি তাঁর গজল বাংলা সংগীতের এক নতুন মাত্রা রচনা করেছে।
কেবল বিদ্রোহী কবি বললেই নজরুলের বিস্তৃত সত্তাকে ক্ষুদ্র করা হয়। তিনি ছিলেন মানবতার কবি, যে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ, নারী-পুরুষ বৈষম্যসহ সকল অসাম্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। ধর্মকে দেখেছেন মানবতার আলোয়, প্রেমকে সাম্যের ভিত্তিতে। তাঁর দৃষ্টিতে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয়।

১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি বাকশক্তি ও লেখনীশক্তি হারান। পরবর্তী ৩৪ বছর কাটে নির্বাক ও নিঃসঙ্গতায়। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা প্রদান করে ঢাকায় নিয়ে আসে। ২৭ আগস্ট ১৯৭৬-এ তিনি চিরনিদ্রায় শুয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মসজিদের পাশে; আজও প্রাত্যহিক শ্রদ্ধা জানায় মানুষ।
সময়ের স্রোত অনেক বদলেছে, তবুও নজরুল আজও সমান প্রাসঙ্গিক। বর্তমান সমাজে যখন ধর্মীয় বিদ্বেষ, অশ্লীলতা, অর্থলোভ ও মানবিক অবক্ষয় বাড়ছে, তখন নজরুলের বিদ্রোহী কণ্ঠের প্রয়োজন মনে হয় বেশি। তাঁর কবিতা শেখায়—স্বাধীনতা হলো কেবল রাজনৈতিক মুক্তি নয়, মানবমুক্তিরও আহ্বান।
আমার ছোটবেলার ডাকনাম ‘নজরুল’ আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমাদের প্রত্যেকের ভেতর লুকিয়ে আছে এক টুকরো ‘নজরুল’। যদি আমরা সেই মানবিক শক্তি, বিদ্রোহী চেতনা এবং প্রেমকে জীবনে ধারণ করতে পারি, তবে সমাজের অন্ধকার থৈথৈ করতে পারবে না।
কাজী নজরুল ইসলাম শুধু কবি নন, তিনি আমাদের আত্মার প্রতিচ্ছবি। তাঁর কবিতা ও গান সময়ের সীমা অতিক্রম করে চিরকাল আমাদের পথ প্রদর্শক হবে। আজকের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা তাঁদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা— বাংলার চিরন্তন বিদ্রোহী কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে।
লেখক: হস্তশিল্প উদ্যোক্তা, শিল্পপুরাণ
এনএম