লাইফস্টাইল ডেস্ক
১৯ জুন ২০২২, ১২:০২ পিএম
ছোট থেকে স্কুলে যাওয়া মানেই আমার কাছে ছিল বাপি- আমার বাবা। ভিকারুননিসায় পড়ার বারো বছরের স্কুল জীবনে হয়তো সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচদিন বাপি আমাকে স্কুলে নিয়ে যায়নি। এছাড়া বারো বছর সপ্তাহে পাঁচদিন ঝড়, বৃষ্টি- যাই হোক না কেন বাপির মোটর সাইকেলে আমি স্কুলে গিয়েছি। ভোরবেলায় আমার ঘুম ভেঙেছে প্রতিদিন বাপির ডাকে- “আব্বা, নামাজের সময় হয়েছে। আমি মসজিদে যাচ্ছি। তুমি নামাজ পড়ে মামকে ডেকে দিও।”
আমি খুব ছোট থেকে লিখি। কিন্তু আমার সবসময়ের আফসোস- বাপি আমার লেখা পড়েন না। বাপি আমার প্রকাশিত বই কয়টা তা অনেকক্ষণ ধরে হিসেব করেও বলতে পারেন না। আমার কোনো লেখা পত্রিকায় এলে সে লেখা পড়েন না। কিন্তু এই যে এত বছর ধরে পত্রপত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হচ্ছে- তবু এখনও যেদিন আমার লেখা পত্রিকায় আসে, সেদিন বাপি আমার মামা, খালামণি, চাচ্চু, ফুপি, বাপির বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী- সবাইকে ফোন করে পত্রিকাটা সংগ্রহ করতে বলেন। বিকেলে পত্রিকা কিনে বাসায় ফেরার পথে নিচে দারোয়ানদেরকে দেখায়- এই যে তার মেয়ের নাম। আমার বই মেলায় আসতে যত দেরিই হোক, একুশে বইমেলার প্রতিটা দিন অফিস থেকে ফিরে আমার ক্লান্ত বাপি বলে, ‘তৈরি হয়ে নাও আব্বা। বইমেলায় ঘুরে আসি।’
আমি বাপির চোখেমুখে, শরীরে সারাদিনের ক্লান্তি দেখি। কিন্তু সেই ক্লান্ত বাপিটা আমার ঠিক আমাকে মোটর সাইকেলে তার পেছনে বসিয়ে বইমেলায় পৌঁছে দেয়।
‘দেয়’ শব্দটা এখন খুব কমই ব্যবহার করতে পারি। লেখাপড়ার জন্য দেশ ছাড়ার পর থেকে আমার জীবনটা আমার একার হয়ে গেছে। প্রতিদিন ঘুম ভাঙে ফোনের অ্যালার্মে, বাপির ডাকে না। ঘুম থেকে উঠে হেঁটে হেঁটে ক্লাসে যাই। বাপি আর হেলমেট হাতে দিয়ে বলে না, ‘দেরি হচ্ছে আব্বা। শিগগির নামো। চলো!’
যখন আমি দেশ ছেড়ে আসার কথা বলতাম, বাপি খুব মন খারাপ করত। আমার এখনও মনে আছে, যেদিন আমি আর বাপি স্যাটের ফি জমা দিয়ে বাসায় ফিরলাম, সেদিন আসর নামাজের পর বাপি এসে মামকে বলেছিলেন, ‘আমি খুব চেষ্টা করলাম, কিন্তু কান্না থামাতে পারলাম না। আজ মসজিদে আমি সারাটাক্ষণ কেঁদেছি। এতদিন মীম বলত শুধু বাইরে যাবে, আমি ভাবতাম ছোট মানুষ, কতকিছুই বলে। হয়তো এমনিই বলছে। হয়তো যাবে না। আজ স্যাটের ফি জমা দিয়ে এলাম। মেয়েটা তবে সত্যিই চলে যাবে?’
ক্লাস এইট কিংবা নাইনে আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম। সেটা ছিল মায়ের লেখা প্রবাসী মেয়ের কাছে চিঠি, যে মেয়েটা পড়াশোনার জন্য ঘর ছেড়েছে। এরপর আরেকটা কবিতা লিখেছিলাম যেটা ছিল মেয়ের লেখা উত্তর। সেই লেখা আমি বাপিকে শুনিয়েছিলাম। বাপি দরজা আটকে কেঁদেছিলেন।
আমার আইইএলটিএস দেওয়া, স্যাটের বই কিনতে নীলক্ষেতে যাওয়া থেকে শুরু করে আমেরিকান দূতাবাসে ভিসার ইন্টারভিউয়ে যাওয়া- কোথাও আমার মাম যায়নি, আমাকে নিয়ে গেছে বাপি একা। আমার দেশের বাইরে আসার পুরো প্রক্রিয়াটায় শুরু থেকে শেষ যে মানুষটা সবসময় ছিল- সেটা আমার বাপি। আমি জানতাম আমি চলে এলে আমাকে ছাড়তে সবচেয়ে কষ্ট হবে বাপির। বাপি যে দেশে থাকতে কখনো আমাকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হতে দিত না। সারাক্ষণ আগলে রাখত।
আমার আমেরিকায় আসার আগের রাতে বাপি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেছিলেন, বছরে অন্তত একবার দেশে এসো আব্বা!
পরদিন এয়ারপোর্টে সবাইকে বিদায় দেয়ার সময় আমার সবচেয়ে দুশ্চিন্তা ছিল বাপিকে নিয়ে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাপি একটুও কাঁদেননি। হাসিমুখে আমাকে বিদায় দিয়েছেন। ইমিগ্রেশন পর্যন্ত বাপি আসতে পেরেছিলেন। আমি যখন ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে এক হাতে সব কাগজপত্র আর অন্য হাতে আমার ক্যারি অন স্যুটকেসটা ধরে, বাপি আমাকে দেখে ফিরে গিয়ে মামকে বলেছিলেন, ‘মীমকে কখনো আমি এই শহরে একা ছাড়তে সাহস পাইনি। কিন্তু এখন ইমিগ্রেশন পেরুচ্ছে যেই মেয়েটা, তাকে আমি একা আমেরিকায় ছাড়তে আর ভয় পাচ্ছি না। আমার মেয়েটার মধ্যে আমি আজ সেই সাহস দেখেছি, শক্তি দেখেছি। আমি জানি ও ঠিক একা একা যেতে পারবে, একা ওখানে থাকতে পারবে। আমার আর কোনো ভয় নেই।’

আজ দেড় বছর চলছে আমি আমেরিকায় এসেছি। আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন আমার মামের সঙ্গে কথা হয়, কিন্তু বাপি একদিনও আমার সাথে কথা বলেন না। মামের পাশে বসে থেকে আমার কথা শোনেন, ক্যামেরার সামনে আসেন না। যদি কেঁদে ফেলে! মাঝেমধ্যে যখন ক্যামেরায় আসেন, শুধু জানতে চান, ‘দেশে কবে আসবে আব্বা? টিকিট করেছ?’
স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন আমার জন্য আমার প্রিয় ভেলপুরি বা ফুচকা কিনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বাপিটা ছোট থেকে কখনো আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করত না। জড়িয়ে ধরা বা চুমু দিয়ে আদর করাটা ঠিক বাপির স্নেহের ধরন না। ক্লাস ফাইভে পিএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ পাওয়ার পর বাপি আমাকে কপালে চুমু দিয়ে আদর করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে আমার বদ্ধ ধারণা হয়ে গিয়েছিল, বোর্ড পরীক্ষায় ভালো করলে বাপি আমাকে কপালে চুমু দেবেন।
সবাই যখন ভালো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বোর্ড পরীক্ষায় ভালো করার চেষ্টায়, আমি তখন শুধু ভালো করতে চেয়েছিলাম ঐ কপালে চুমুটার জন্য। জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি- সবগুলোতে গোল্ডেন জিপিএ পাওয়া আর একবার করে বাপির দেয়া কপালে চুমুর পর আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল এইচএসসির রেজাল্টের দিন। মনে হয়েছিল, বোর্ড পরীক্ষা তো শেষ। বাপি তো আর আমাকে চুমু দিয়ে আদর করে দেবেন না!
ঠিক তখনই মনে হয়েছিল, আমি বাইরে চলে গেলে নিশ্চয়ই যাওয়ার সময় বাপি আমাকে আদর করে দেবেন! আমাকে খুব দ্রুত বাইরে চলে যেতে হবে!
চলে আসার পর থেকে মনে হতো, আমি দেশে গেলে নিশ্চয়ই বাপি আমাকে চুমু দিয়ে আদর করে দেবেন। আমাকে দেশে যেতে হবে! গত শীতে একবার দেশে গিয়েছিলাম। কয়েক মাস আগের কথা হলেও সেটা এখন অনেকদিন মনে হয়। বাপি কি জানে, বাপির চেয়ে আমি অনেক বেশি অধীর হয়ে অপেক্ষায় আছি দেশে ফেরার- ঐ কপালে চুমুটার জন্য?
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গ কলেজের শিক্ষার্থী
এনএম