images

লাইফস্টাইল

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন: সমাজের তাচ্ছিল্যের শিকার নতুন মায়ের যে বিষণ্ণতা

নিশীতা মিতু

১২ মার্চ ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম

সম্প্রতি ভারতে এক মা তার নবজাতক দুই সন্তানকে হত্যা করেছেন। কারণ তারা দিনরাত কাঁদত— এই দুটো বাক্য পড়ে নিশ্চয়ই আপনি আঁতকে উঠছেন। একজন মা কী করে তার নাড়িছেঁড়া সন্তানকে মেরে ফেলতে পারে! এও কী সম্ভব! 

পুলিশি জেরায় সেই নারী জানান, ‘মেয়েরা দিনরাত কাঁদত। তাই তিনি বিশ্রাম নেওয়ার কোনো সুযোগ পেতেন না। এই কান্নার জন্য কয়েক রাত ঘুমাতে পারেননি তিনি। ঘটনার দিন সন্তানদের কান্নায় বিরক্ত হয়ে প্রথমে একটি লেপ দিয়ে তাদের মুখ ঢেকে দেন। এতে তারা আরও জোরে চিৎকার করলে ওড়না দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। 

কেন সন্তানদের প্রতি বিরক্ত হলেন এই নারী? কেন তিনি এমন হিংস্র সিদ্ধান্ত নিলেন? কী এমন বোধ তাকে বাধ্য করল নিজের সন্তানকে হত্যা করতে? 

Postpartum-depression1

বলা হয় একজন নারীর জীবনের পূর্ণতা আসে মাতৃত্বের মাধ্যমে। মা হওয়া নিয়ে তাই হাজারো জল্পনা-কল্পনা খেলা করে একজন নারীর মনে। দীর্ঘ ৯ মাস অক্লান্ত শারীরিক কষ্ট সহ্য করার পর সন্তান জন্ম দেন নারী। কাঙ্ক্ষিত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ভুলে যান জীবনের সব দুঃখ-কষ্টের অনুভূতি। তবে মাতৃত্বের এই স্বাদ কখনো কখনো আনন্দের বদলে রূপ নেয় বিষাদে। নতুন মায়ের মনে সৃষ্ট হওয়া এই বিষণ্ণতাকে বলা হয় পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা। 

ডিপ্রেশন কী?

ডিপ্রেশন বলতে একটি সাধারণ মানসিক স্বাস্থ্যগত অবস্থাকে বোঝানো হয়। প্রায়ই উদ্বেগের পাশাপাশি এটি বিকাশ লাভ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর দেওয়া গাইডলাইন অনুযায়ী ডিপ্রেশনকে কয়েকটি বিষয় দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো- দুঃখ, আগ্রহ বা আনন্দ হারিয়ে ফেলা, অপরাধবোধ, নিজেকে মূল্যহীন লাগা, ঘুম ও ক্ষুধায় বিরক্তি, ক্লান্তি, দুর্বল মনোযোগ।

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কী? 

প্রসবোত্তর বিষণ্ণতার সংক্ষিপ্ত রূপ (পিপিডি)। সন্তান জন্মদানের পরবর্তী সময়ে মায়ের এই বিষণ্ণতা দেখা দেয়। তবে এটি নিয়ে অতটা ঘাবড়ানোর কিছু নেই। কেননা প্রায় ৭০% নতুন মা ই এমন বিষণ্ণতায় ভোগেন। যা সপ্তাহ দুয়েক স্থায়ী হয়। এসময় দুঃখবোধ মনের ভেতর ডালপালা ছড়ায়। পাশাপাশি জেঁকে বসে অপরাধবোধ। মনে হয় সন্তানের সঠিক যত্ন নিতে পারছেন না। 

‘আমি কি ভালো মা হতে পারবো না? কেউ কেন আমার খেয়াল রাখে না? আমি কি একটু বিশ্রাম নিতে পারব না?’— এমন সব ভাবনা যখন অবসাদের কারণ হয় তখন তাকে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বলা যায়। 

postpartum_depression2

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কেন হয়? 

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের পেছনে এককভাবে কোনো কারণকে দায়ী করা সম্ভব নয়। তবে কিছু শারীরিক ও মানসিক বিষয় এক্ষেত্রে সমস্যাকে উসকে দেয়। 

শারীরিক পরিবর্তন

সন্তানের জন্মের পর নারীর শরীরে বিশেষ কিছু হরমোনের (যেমন এস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন) ঘাটতি দেখা দেয়। এগুলো পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন ঘটাতে পারে। এছাড়া থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে উৎপাদিত আরও কিছু হরমোনের পরিমাণও কমতে পারে। যার কারণে দুর্বলতা, অলসতা, বিষণ্ণতা অনুভূত হতে পারে।

মানসিক কারণ

কারো যদি পরপর অনেকদিন ঘুমের ঘাটতি হয় এবং সবসময় উত্তেজিত থাকে তাহলে অনেক ছোটোখাটো বিষয় সামলানোও তার জন্য কঠিন হতে পারে। অনেক নতুন মা ই নবজাতক সন্তানের যত্নের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকেন। বারবার মনে করেন, সঠিক যত্ন নিতে পারছেন না। নিজেকে দোষারোপ করতে থাকেন। যা পরবর্তীতে বিষণ্ণতায় কারণ হয়। 

postpartum-depression3

আরেকটি বিষয় হলো পরিবার বা আশেপাশের মানুষের ব্যবহার। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সবার নজর থাকে নবজাতকের প্রতি। সে ভালো আছে কি না, সে কী করছে তা নিয়েই ভাবনা থাকে সবার। সবার অজান্তেই কোণঠাসা হয়ে পড়েন নতুন মা। তার স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে ভালো-মন্দ কোনো কিছুর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না অন্যরা। 

নয় মাস গর্ভধারণের পর এমনিই নতুন মায়ের মানসিক পরিস্থিতি বেশ আবেগপ্রবণ আর নাজুক থাকে। এমন পরিস্থিতিতে সন্তানের প্রতি বাড়তি মনোযোগ আর নিজের প্রতি অবহেলার কারণে তিনি আত্মপরিচয়হীনতায় ভুগতে পারেন। ‘আমি এত গুরুত্বহীন কেন?’, ‘কেউ আমাকে ভালোবাসে না কেন?’, ‘আমার কি কোনো মূল্য নেই?’— এমন অসংখ্য ভাবনাই পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের কারণ হতে পারে। 

আবার অনেক পরিবারে সন্তানকে লালনপালন করার মতো সাহায্যকারী কেউ থাকেন না। একা সন্তানকে পালন করতে গিয়ে মায়ের ঘুম, বিশ্রাম কিছুই হয় না। যা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। অনেকক্ষেত্রে, পরিবারের বড়রা মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন নিয়ে অযাচিত মন্তব্য ও পরামর্শ দিতে থাকেন। এগুলোও নতুন মায়ের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। 

বাড়তি ওজন নিয়ে হাসি ঠাট্টা, আর্থিক উদ্বেগ, সম্পর্কের টানাপোড়েন বা গর্ভাবস্থা বা প্রসবের সময় অপ্রত্যাশিত জটিলতাগুলোও এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে।

postpartum-depression4

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ

  • দুঃখবোধ হওয়া কিংবা অসহায় লাগা।
  • অস্থির লাগা বা মেজাজ খারাপ হয়ে থাকা।
  • সন্তানের প্রতি কোনো আগ্রহ কাজ না করা, তার থেকে দূরে থাকা। অর্থাৎ এমন মনে হওয়া যে সন্তান নিজের নয়, অন্য কারোর।
  • শিশুকে বা নিজেকে আঘাত করার কথা চিন্তা করা।
  • অপরাধবোধে ভোগা বা নিজেকে খারাপ মা মনে হওয়া।
  • কোনো কাজে শক্তি বা অনুপ্রেরণা না পাওয়া।
  • খুব কম খাওয়া কিংবা অতিরিক্ত খাওয়া।
  • পরিবার ও বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
  • স্মৃতিঘটিত সমস্যা হওয়া ইত্যাদি। 

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন প্রতিরোধের উপায় 

এই অবসাদ থেকে নতুন মা কে মুক্তি দেওয়ার মূল টনিক হলো পরিবারের ভালোবাসা আর আদর-যত্ন। পরিবারের সমর্থন আর ভালোবাসা থাকলে দ্রুত এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন স্বামী। সন্তানের পাশাপাশি স্ত্রীকে ভালোবাসুন। তিনি ঠিকমতো খাচ্ছেন কিনা, তার প্রিয় বিষয়গুলো নজরে রাখুন। 

postpartum-depression5

সন্তান পালনের দায়িত্ব কেবল মায়ের নয়। বাবা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যদেরও এক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে আসা উচিত। তাহলে নতুন মা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পাবেন। তার প্রিয় খাবার এনে দিন। কিংবা তাকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরে আসুন। নতুন মায়ের দায়িত্ব নিয়ে কটু কথা বলা পরিহার করুন। 

এরপরও সমাধান না মিললে এবং এই বিষণ্ণতা দুই মাসের বেশি স্থায়ী হলে একজন দক্ষ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান। তিনি প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ, থেরাপির পরামর্শ দেবেন। 

প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করে যে নারীটি এই পৃথিবীতে নতুন একটি প্রাণ নিয়ে আসেন তাকে অবহেলা করবেন না। বরং তার পাশে থাকুন। মাথায় ভরসার হাত রাখুন, ভালোবাসুন। তাহলেই দূর থাকবে সব অবসাদ। 

এনএম