১২ মে ২০২৪, ১১:২৮ এএম
৬-৭ বছর আগের কথা। আমার স্ত্রী আর সন্তানরা ঢাকার বাইরে গিয়েছিল। ছুটি পাইনি বলে আমি যেতে পারিনি, বাসায় একাই ছিলাম। এই সময় মা একদিন ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি যে রাতে একা বাসায় থাকো, ভয় করে না?’ আমি হাঁসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না। চিন্তা করে দেখেন, ৫৬-৫৭ বছর বয়সী ছেলেকে মা জিজ্ঞেস করছে, রাতে তার একা থাকতে ভয় করে কিনা। এই হচ্ছে মা, যার কাছে সন্তান সবসময় ছোটই থাকে, একা থাকলে ভয় পাবার বয়সের মতো।
করোনার মধ্যে একসঙ্গে বাবা-মাকে হারিয়েছেন এমন হতভাগ্যের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু আমি তাদের একজন। অনেকে অবশ্য এটাও বলেন, মহামারিতে যারা মারা যান তারা শহীদের মর্যাদা পান। সেটি সত্য হলে আমি অবশ্যই ভাগ্যবান। ৮০-র ঘরে থাকা মা-বাবাকে মাত্র ৩ দিনের ব্যবধানে হারানোর পর অবশ্য অনেকে এই বলেও সান্ত্বনা দিয়েছেন যে, অনেকদিন তাদের স্নেহ-মমতা পেয়েছি, অনেকে তো বুঝতে শেখার আগেই মাকে হারিয়েছে। কথাটা সত্যি, কিন্তু মন কি আর তা মানে?
আমার এখনো বিশ্বাস হয় না, বাবা-মা নেই। বাবা-মা বেঁচে থাকতে তাদের মর্যাদা-মূল্য-সময় আমরা অনেকেই দিই না। তারা যখন গ্রামের বাড়িতে থাকতেন তখন যে প্রতিদিন ফোনে কথা হতো তা নয়, মাঝেমধ্যে ৩-৪ দিন গ্যাপ হয়ে যেত। ঠিক সেই কারণেই কখনও কখনও আমার মনে হয় সেই গ্যাপের সময়টাই চলছে। এ রকম অবস্থায় মা-ই ফোন করতেন। সেই চিরাচরিত ভাষায় জানতে চাইতেন, ‘কেমন আছো ব্যাটা? অনেকদিন কথা হয় না, ভালো আছো তো?’
মাকে ছাড়া সন্তানরা কখনো ভালো থাকতে পারে না, মা। তোমার কাছ থেকে শেখা দর্শন নিয়েই চলছি। সেটা হলো— খারাপ থাকলেও তা বুঝতে না দিয়ে ভালো থাকার অভিনয় করা। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই আমার মায়ের কেটেছে অসুস্থতা ও অভাবের সংসারে টানাটানির মধ্যে। কিন্তু কাউকে কখনও তা বুঝতে দিতে চাইতেন না। অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যেতে চাইতেন না, গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় আসতে চাইতেন না। বলতেন, ‘ভালো আছি, তোমরা মাঝে মাঝে এসে দেখে যেও।‘
কিন্তু শহরের জীবনে আমরা আসলে যতটা ব্যস্ত থাকি তারচেয়েও বেশি ব্যস্ততার ভান করি। এমন বাস্তবতায় খুব বেশি যাওয়া হতো না। তবে একটা ঈদ, সাধারণত কোরবানির ঈদ মা-বাবার সঙ্গে কাটাতে আমরা ভাইবোনেরা সবাই বাড়িতে যেতাম। ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে বারান্দায় চেয়ারে বসে থাকা মায়ের পায়ে সমর্পিত হতাম। সেই চেয়ার এখনও আছে, কিন্তু শূন্য। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে আজন্ম পরিচিত, খুব চেনা সেই পা দুটি খুঁজি, কিন্তু মেলে না।

মা দিবসে অনেকেই ফেসবুকে তাদের মায়েদের ছবি দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। আমার কাছে সবাইকে দেখতে একইরকম মনে হয়। আসলেই তো, মায়েরা সবাই একই রকম। এখন এরকম গান-কবিতা লেখা হচ্ছে— মা হলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী, সন্তানের খাবার যেন কম না পড়ে সে জন্য না খেয়ে থেকেও বলেন খেয়েছেন। অসুখ হলেও বলেন কিছু হয়নি। সবচেয়ে স্বার্থপর, সন্তানের খারাপ দিকটা কখনো দেখতে পান না। সবচেয়ে বড় চোর, সন্তানদের শখ মেটানোর জন্য তাদের বাবার পকেট থেকে টাকা সরিয়ে রাখেন। এমন আরো অনেক কিছু।
মা তো মনে হয় স্রষ্টার প্রতিনিধি। সৃষ্টিকর্তা নিজে সশরীরে পৃথিবীতে থাকেন না বলে ঘরে ঘরে মায়েদের পাঠিয়ে দেন।
রেজোয়ান হক
সাংবাদিক