নিশীতা মিতু
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:০৭ এএম
বাংলা ভাষা। মায়ের ভাষা। যে ভাষায় মনের সবটুকু অনুভূতি প্রকাশ করা যায় প্রাণ খুলে। আনন্দ কিংবা রাগ, দুঃখ কিংবা অভিমান— সব যেন বাংলায় বলেই সুখ। অথচ এই ভাষায় নির্দ্বিধায় কথা বলার অধিকারটুকু আদায় করতেও লড়তে হয়েছে, দিতে হয়েছে প্রাণ।
আজ ২১ ফেব্রুয়ারি, মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর পূরণ হওয়ার দিন। বাঙালি জাতির জন্য শোক আর বেদনার একটি দিন এটি। ১৯৫২ সালের এদিনে ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠীর চোখ-রাঙানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে।
পাকিস্তানি শাসকরা সেদিন শঙ্কিত হয়ে ওঠে বাংলার দামাল ছেলেদের হুংকারে। তাইতো ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকসহ আরও অনেকে।
ভাষা আন্দোলনের এতগুলো বছর পেরিয়ে একুশ যেন এখন কেবল একুশে ফেব্রুয়ারিতেই আটকে আছে। ভিনদেশি ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার মিশ্রণ হয়ে উঠেছে আমাদের মুখের ভাষা। বছরের অন্য দিনগুলোতে ভাষার প্রতি সম্মান দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেন না বেশিরভাগ মানুষ। কেবল ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ শহীদ মিনারে ফুল দিয়েই কি ভাষা শহীদদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা দেখানো সম্ভব?
সাদা-কালো পোশাক পরিধান করেই কি কেবল ভাষার প্রতি সম্মান জানানো যায়? না। এটি মনেও লালন করতে হয়। প্রতিনিয়ত শ্রদ্ধা হারাচ্ছে শহীদ মিনারও। বছরের এই একটি দিন এলে ধোয়া মোছা করে সাজানো হয় শহীদ মিনারকে। এরপর আর যত্ন থাকে না। এমনকি অনেক জায়গায় শহীদ মিনার হয়ে ওঠে মাদক গ্রহণকারীদের আড্ডাখানা। একুশে ফেব্রুয়ারি খালি পায়ে সম্মান জানালেও সারা বছর একশ্রেণির মানুষ জুতা পায়েই নির্বিকার ঘুরে বেড়ান শহীদ মিনারের বেদিতে। নিত্যপ্রহর সেখানে চলে আড্ডা। কোনো কোনো অবহেলিত শহীদ মিনারে ঘুরে বেড়ায় বাঁধহীন গরু-ছাগলও। অথচ এই বেদি শ্রদ্ধা নিবেদনের স্থান।
যে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল বাংলার দামাল ছেলেরা, যে ভাষাকে অর্জন করতে হয়েছিল অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে, তা যেন আজ বিবর্ণ, মর্যাদাহারা। থেমে গেছে প্রমিত বাংলার চর্চা। উদ্ভট বাংলার ছড়াছড়ি এখন সর্বত্র।
বর্তমানে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সুবিশাল। কালে কালে অনেক শব্দ এসে জায়গা করে নিয়েছে এই ভাষায়। তবে সুন্দর বাংলা শব্দ থাকার পরও ইংরেজি, হিন্দি ইত্যাদি ভাষায় সেসব শব্দ উচ্চারণের বিষয়টি আক্ষেপের বটে। বাংলা ভাষায় কথা বলার বদলে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিশিয়ে জগাখিচুড়ি এক ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে এখন। যা বাংলার মান-মর্যাদা-গৌরব ক্ষুণ্ণ করে। বাংলা ভাষার নিজস্বতাকে টেনে নেয় বিলুপ্তির পথে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতি সত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এই একটি দিন ভাষা শহীদদের স্মরণ করে, শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে কিংবা সাদা-কালো পোশাক পরে যতটা শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয় তারচেয়ে বহুগুণ বেশি করা হবে যদি বছরজুড়ে আমরা ভাষার প্রতি সচেতন থাকি। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। এ ভাষার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। একদিন নয়, প্রতিদিনই ভালোবাসতে হবে মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা বাংলাকে।
এনএম