আমিনুল ইসলাম মল্লিক
০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩১ পিএম
মামলার জট কমাতে ও মিথ্যা মামলা পরিহার করতে ছোটখাটো বিষয়ের কিছু মামলা আদালতে আসার আগেই নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রাথমিকভাবে দেশের ১২ জেলায় পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জেলাগুলো হলো সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারসহ দেশের আরও নয় জেলা। আটটি আইনের ক্ষেত্রে আর সরাসরি মামলা গ্রহণ করবে না আদালত।
ইতোমধ্যে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা এ নিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আইন সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ (২০২৫ সনের ৩৫ নং অধ্যাদেশ) এর ধারা ১ এর উপধারা (২) এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও রাঙামাটি জেলায় আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০ (২০০০ সালের ৬ নং আইন) এর ২১ খ ধারার বাধ্যতামূলক মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার বিধান কার্যকরের দিন ধার্য করা হয়েছে। ধার্য তারিখ অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) থেকে এই বিধান কার্যকর হয়েছে।
সংশোধিত আইনের তফসিল অনুযায়ী যে আট আইনের অধীনে উদ্ভূত বিরোধ বা অভিযোগের বিষয়ে আদালতে সরাসরি মামলা করা যাবে না, সেগুলো হলো—পারিবারিক আদালত আইন, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত বণ্টন সম্পর্কিত বিরোধ, স্টেট অ্যাকুজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, নন-এগ্রিকালচারাল টেন্যান্সি অ্যাক্ট, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন, যৌতুক নিরোধ আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন।
গণবিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, উল্লেখিত ধারার বিধানমতে চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার (বিচারক) কর্তৃক প্রত্যায়িত প্রতিটি মধ্যস্থতা চুক্তি চূড়ান্ত, বলবৎযোগ্য এবং পক্ষগণের ওপর বাধ্যকর হবে এবং আদালতে ডিক্রি অথবা ক্ষেত্রমত চূড়ান্ত আদেশ হিসেবে গণ্য হবে।
বুধবার বিকেলে নতুন এ বিধির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা যা করেছি, তা দেশের ইতিহাসে নেই। কম সময়ে যে পরিবর্তন করেছি, পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার যদি তা ধরে রাখে তাহলে দেশে ন্যায়বিচার আরও বৃদ্ধি পাবে। দরিদ্র ও অসহায় মানুষের আইনগত প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ অনেক বেশি বাড়বে।
মামলার জট কমাতে মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক কার্যক্রম চালুর উদ্যোগকে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে দরিদ্র মানুষের জন্য অপূর্ব সুযোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা কয়েকটি নতুন পরিবর্তন এনেছি। প্রথমত, মামলা দায়েরের আগে লিগ্যাল এইডে যাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেখানে সমাধান না হলে আদালতে যেতে কোনো বাধা থাকবে না। দ্বিতীয়ত, কয়েকটি আইন সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যেখানে লিগ্যাল এইডে যাওয়া বাধ্যতামূলক। তৃতীয়ত, আগে লিগ্যাল এইডে দায়িত্বে থাকতেন একজন সিনিয়র সহকারী জজ। এখন থাকবেন সিনিয়র যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে এ বিধান কার্যকর হয়েছে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বাড়বে না কমবে তা নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. তানভীর আহাম্মেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, সরকার প্রাথমিকভাবে ১২টি জেলায় আট আইন নিয়ে যে নিয়ম চালু করেছে, এতে দেখতে হবে কতটুকু সফল হওয়া যায়। এগুলো পরীক্ষামূলকভাবে করা হচ্ছে। সফলতার হার দেখে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। যেসব আইনের কথা বলা হয়েছে, এসব মামলাগুলো সাধারণত মিথ্যা হয়ে থাকে। সেই মিথ্যা মামলাগুলো যদি আদালতে আসার আগেই মীমাংসা হয়ে যায় তাহলে ভালো। আর যদি মীমাংসা না হয় সেক্ষেত্রে আদালতে যাওয়ার সুযোগ তো আছেই। অতএব আমি বলব, ১২টি জেলায় প্রাথমিকভাবে সরকার যেসব আইনের বিষয়ে লিগ্যাল এইডে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে সেটি ইতিবাচক উদ্যোগ বলে মনে হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জহিরুল ইসলাম লিমন ঢাকা মেইলকে বলেন, সংশোধিত এ আইনগুলো বিচারপ্রার্থীর দুর্ভোগ আরও বাড়াবে।
তিনি বলেন, এই আইনের তফসিলে বর্ণিত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ পক্ষকে আবশ্যিকভাবে উক্ত বিরোধ প্রথমে লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে আবেদন করতে হবে এবং মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে বিরোধের কোনো পক্ষ প্রয়োজনে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে।
প্রশ্ন উঠেছে—এই বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা কি বিচারপ্রার্থী জনগণের জন্য আশীর্বাদ, নাকি আরেক দফা হয়রানি? প্রথমত, লিগ্যাল এইড অফিসে যাওয়া মানে এক নতুন প্রক্রিয়া শুরু হওয়া, যা মামলা শুরুর পূর্বে বাড়তি সময় ও জটিলতা সৃষ্টি করবে। এই প্রক্রিয়ায় মামলা গ্রহণের পূর্বে কাগজপত্র যাচাই, ডাকাডাকি, তারিখ নির্ধারণ, মধ্যস্থতার সময়সীমা—সব মিলিয়ে বিচারপ্রার্থীকে আরও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, লিগ্যাল এইড অফিসের সুবিধা প্রাপ্তি ও কার্যকারিতা সারাদেশে এখনো সমভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। অনেক এলাকায় দক্ষ মধ্যস্থতাকারী, পর্যাপ্ত জনবল ও অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। এর ফলে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হতে পারেন, বিশেষ করে যাদের মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, আর্থিক খরচের কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদিও লিগ্যাল এইড মূলত বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়ার কথা, কিন্তু প্রক্রিয়ার দীর্ঘায়ন ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন, যাতায়াত ও সময় ব্যয় ইত্যাদি মিলে ব্যক্তিগত খরচ বেড়ে যায়। এমনকি অনেক সময় ক্লায়েন্টরা দ্বৈত খরচের মুখোমুখি হন—প্রথমে মধ্যস্থতা, পরে মামলার ব্যয়।
এই গেজেট অনুযায়ী চেক ডিজঅনার, ভাড়া সংক্রান্ত বিরোধ, বণ্টন মামলা, যৌতুক নিরোধ কিংবা পিতামাতার ভরণপোষণের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে সরাসরি আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যাবে না। এটি সাধারণ মানুষকে ন্যায়বিচার থেকে দূরে ঠেলে দিতে পারে।
এই আইনজীবী আরও বলেন, এই ধরনের বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা চালু করার আগে সিনিয়র আইনজীবী, বিচারপতি ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করাই ছিল সমীচীন। কারণ, আইনের উদ্দেশ্য যদি হয় ন্যায়বিচার সহজতর করা, তাহলে যে কোনো প্রক্রিয়া যদি বিচারপ্রাপ্তির পথকে দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল করে তোলে তবে তা মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়।
এআইএম/এআর