images

আইন-আদালত

মামলার জট কমাতে সরকারি উদ্যোগে আশার আলো

আমিনুল ইসলাম মল্লিক

০৭ মে ২০২৫, ০৯:১৭ পিএম

  • জোরদার হচ্ছে লিগ্যাল এইড কার্যক্রম
  • বন্ধ হচ্ছে ছোটখাটো বিষয়ে আদালতে যাওয়ার পথ
  • ৪০ শতাংশ মামলার জট কমানোর টার্গেট
  • সহজেই মিলবে আইনি সেবা, পাবে সবাই

আদালতপাড়ায় মামলা জটের যে সমস্যা সেটা অনেক পুরনো। এই সমস্যা দিন দিন শুধু বেড়েছেই। দাদার আমলে হওয়া মামলার বোঝা নাতি টানছে এমন উদাহরণও আছে অনেক। আইনের শাসন ও সুবিচার পাওয়ার প্রশ্নে মামলা জট বড় বাধা। হাজার হাজার মামলার ভারে দেশের বিচার বিভাগ বিপর্যস্ত।

অন্তর্বর্তী সরকার মামলার সেই জট কমাতে যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকারিভাবে আইনগত যে সহযোগিতা দেওয়া হয় সেটাকে আরও জোরদার করা হচ্ছে। ছোট ছোট কিছু মামলা বিচারিক আদালতে যাওয়ার আগেই নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চেক ডিজ-অনার, পারিবারিক বা সম্পদ নিয়ে ছোটখাটো বিরোধে জড়িয়ে কেউ যেন সরাসরি আদালতে চলে না যায়, সে ব্যাপারে ভাবা হচ্ছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির দিকে জোর দিতে চায় সরকার। সে অনুযায়ী কাজ শুরু করেছে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সরকারের এই উদ্যোগ সফল হলে মামলার জট অনেকটা কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে আইন অঙ্গনে আশার আলো দেখা যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকারি জাতীয় আইনগত সেবা প্রদানকারী সংস্থা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের আইনি সেবা দিচ্ছে। তৃণমূলের মানুষের এই সেবা পেয়ে বেশ খুশি। ইব্রাহীম শাওন নামে এক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেইলের। তিনি জানালেন, লিগ্যার এইডের সেবায় তার সংসারে আনন্দ ফিরে এসেছে। তিনি বলেন, পারিবারিক কলহের কারণে আমি আর আমার স্ত্রী পৃথক হয়ে যাই। সংসারে অশান্তি নেমে আসে। পরবর্তী সময়ে আমাদের দুজনের বিষয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা হয়। সে মামলায় আমাকে জেলা লিগ্যাল এইড থেকে নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশ পেয়ে আমি আর আমার স্ত্রী ওখানে যাই। এরপর আমাদের নিয়ে বসেন লিগ্যাল এইডের কর্মকর্তা আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টরা। বিস্তারিত শুনানি করে আমাদের ঝামেলা মিটিয়ে দেন। এখন আমরা ভালোভাবে সংসার করছি। আনন্দ ফিরে আসে আমাদের সংসারে।

ইতোমধ্যে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান কেন্দ্রের তৎপরতায় মামলা জট কমতে শুরু করেছে। গেল বছর এ সংস্থা থেকে প্রতিকার পেয়েছেন চার হাজার ৪৩১১ বিচারপ্রার্থী। বিকল্প বিরোধের মাধ্যম নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৩০ হাজার ১৬৬টি মামলা।

জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদানকারী সংস্থার পরিচালক জেলা ও দায়রা জজ আজাদ সোবহানী এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, বিচারপ্রার্থীদের অনলাইন অফলাইনে আইনি সেবা দিয়ে যাচ্ছে লিগ্যাল এইড। দেশের ৬৪ জেলা ও সুপ্রিম কোর্টে প্রতিষ্ঠা করা লিগ্যাল এইডের এমন উদ্যোগে মামলা জট কমবে বলে আমরা আশা করছি।

জেলা ও দায়রা জজ বলেন, আইনের প্রতিকার পাওয়া সব মানুষের অধিকার। আইনের সুযোগ লাভের অধিকারও সব মানুষের। দেশের ৬৪টি জেলা ও সুপ্রিম কোর্ট মিলে আমরা নিরন্তরভাবে বিচারপ্রার্থীদের সময় দিয়ে যাচ্ছি। মামলা দায়েরের আগে ও পরে আমরা মামলা মীমাংসার চেষ্টা করছি। এতে করে বিচারপ্রার্থী সবাই প্রতিকার পাচ্ছেন। বিচার বিভাগের কথিত মামলা জট কমছে।

asif-nazrul
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।

মামলা জট কমাতে আইন উপদেষ্টার পরিকল্পনা

মামলা জট নিয়ে সরকারও উদ্বিগ্ন। অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল মামলা জট কমানোর নানা দিক নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন। তিনি বলেন, আজকে এত বছর পর আল্লাহ আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন কাজের। আইনগত সংস্থা আছে। এ সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে আছি। আমরা এ বছর অনেকগুলো পরিকল্পনা নিয়েছি। আমি খবর নিয়ে জানতে পারলাম যে, আমাদের দেশে প্রতি বছর পাঁচ লাখ মামলা হয়। সরকারি লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয় ৩৫ হাজার মামলা।

উপদেষ্টা বলেন, আমি যদি লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে এই পরিমাণটা দুই লাখে আনতে পারি তাহলে আদালতে মামলা জট কমে যাবে প্রায় ৪০ শতাংশ। আমাদের এখানে লিগ্যাল এইডে মামলা নিষ্পত্তি করা বাধ্যতামূলক না।

আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের কিছু কিছু মামলা আছে যেমন পারিবারিক আদালতের মামলা। চেক ডিজ অনারের মামলাসহ কিছু ছোট ছোট মামলা। এগুলোকে যদি আমরা ম্যান্ডেটোরি হিসেবে ধরি তাহলে প্রথমে যেতে হবে সরকারি লিগ্যাল এইডের কাছে। ওখানে নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ হলে কোর্টে আসতে হবে, তাহলে বিপুল পরিমাণ মামলা জট কমবে।

আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, আমরা কাজের সুবিধার জন্য জাতীয় আইনগত সংস্থার নাম পরিবর্তন করব। ফোন নম্বরও চেঞ্জ করবো। ছোট ছোট ব্যাপার। এখানে ৫টা ডিজিটের নম্বর দেওয়া আছে। কিন্তু এটাও অনেকেই মনে রাখতে পারেন না। আমরা এটাকে সহজ করে নেব। যেমন ৫৫৫৫, ৬৬৬ দিতে পারি। ছোট ছোট কাজ মানুষের জন্য অনেক সহজ করে দেওয়া যায়। আমরা যদি ছোট ছোট মামলাগুলো মীমাংসা করার জন্য লিগ্যাল এইডে যেতেই হবে। এরকম নিয়ম করলে মামলাজট তাড়াতাড়ি কমে যাবে। লিগ্যাল এইডের সেবায় জেলা জজ আদালতে যুগ্ম জেলা জজ যদি থাকেন, তাহলে সুবিধা হয়। কারণ উনি দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা নিয়ে অভিজ্ঞ। একজন সিনিয়র সহকারী জজ থাকবেন। আমাদের জানামতে জেলা ও দায়রা জজ থেকে বিদায় নেওয়া অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন। তাদের আমরা কাজে লাগাতে চাই। তারা এখনো প্রচণ্ড ফিট। আমরা তাদের কাজে লাগাবো।

উপদেষ্টা বলেন, লিগ্যাল এইডে তিনজন আইন কর্মকর্তা থাকবেন। তাদের মধ্যে একজন হবেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ। সাধারণ মানুষ অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের কাছে যেতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমরা খুবই কনফিডেন্ট আগামী ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় আইনগত সেবা প্রদানকারী সংস্থাকে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করব, যাতে করে প্রতি বছর এক লাখ করে মামলা নিষ্পত্তি হয়। আমি মনে করি বাংলাদেশের বিচারপ্রার্থী মানুষের জন্য এটা অনেক বড় পাওয়া হবে। আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর কিছু উদ্যোগ নিয়েছি, যা বিচার কাজে বিড়ম্বনা কমাবে, সময় বাঁচাবে। ইতোমধ্যে আমরা কিছু সংস্কার করেছি। এখন অমাদের এ সংস্কার হয়ত বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু যারা আইন বিশেষজ্ঞ আছেন তারা বুঝতে পারছেন।

আসিফ নজরুল বলেন, আমরা সিপিসির যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনারা জানেন, সিপিসিতে কিছু বিষয়ে সংস্কার করেছি। সমন যাবে মেসেজের মাধ্যমে। মোবাইলের মাধ্যমে। আগের মতো আর এগুলো মাসের পর মাস সময় লাগবে না। এর আগে ডিগ্রি জারির জন্য আলাদা মামলা করতে হতো। এখন আর এগুলো করতে হবে না। আমরা সিপিসির পাশাপাশি সিআরপিসিতেও অনেক সংস্কার করতে যাচ্ছি। আপনারা আগামী এক মাসের মধ্যে বুঝতে পারবেন। আমরা যদি বিচার করার সময় কমিয়ে আনতে পারি, বিচার করার সময় যেমন ১০ বছরেরটা যদি পাঁচ বছরের মধ্যে আনতে পারি, তাহলে বিচারপ্রার্থী মানুষের অনেক উপকার হবে। মামলার জট কমবে।

এআইএম/জেবি