images

আইন-আদালত

থমকে আছে বিচার কাজ, বিচারক নিয়োগ কবে?

আমিনুল ইসলাম মল্লিক

১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১০ পিএম

  • আইন সংস্কার, দক্ষ ও যোগ্য বিচারক নিয়োগের প্রত্যাশা
  • জেলা জজ, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীও নিয়োগ দেওয়া যাবে
  • কাজ শুরু করেছে প্রসিকিউশন, যাচ্ছেন হাসপাতালগুলোতে
  • তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে চিঠি দেওয়া হয়েছে সারা দেশে

২০১০ সালে চালু হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ। প্রায় ১৪ বছর ধরে চলেছে তা। কিন্তু বিচারক সংকটসহ নানা কারণে গত ১৩ জুন বন্ধ হয়ে যায় এই আদালতের কার্যক্রম। ৩০টি মামলার বিচার চলমান থাকা অবস্থায় বন্ধ হয়ে যায় এটি। বন্ধ থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপক্ষে চিফ প্রসিকিউটরসহ ৪ জন প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয় সরকার। রুটিন মাফিক কিছু কাজও করছেন তারা।

বিগত সরকারের সময় যারা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন তারাও ট্রাইব্যুনালের বাইরে। তিন মাসের বেশি বন্ধ থাকা এ বিচারালয়টি কবে নাগাদ চালু হবে সেটিও স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির স্বার্থে দ্রুতই চালু করতে হবে এই আদালতটি। যোগ্য ও দক্ষ ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞদেরকে নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ তাদের। একইসঙ্গে এই আইনের সংস্কারও চান তারা।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির ঢাকা মেইলকে বলেন, খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। অভিজ্ঞ ও দক্ষ যারা ফৌজদারি মামলা ভালো বোঝেন তাদের মধ্য থেকে বিচারক হিসেবে এই ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ দেওয়া জরুরি।

কারা হবেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক? এমন প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, জেলা জজ, অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতি, কোনো আইনজীবী বা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট থেকে কোনো বিচারককেও এখানে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বিচারক নিয়োগের আগে এই আইনটি সংশোধনের প্রয়োজন আছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রক্তপাতের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ছাড়াও সারা দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে ইতিমধ্যে শতাধিক মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় বিচার হবে শুধুমাত্র এই ট্রাইব্যুনালেই। একই অপরাধে একাধিক মামলা ও বিচার হতে পারে না বলেও জানান শিশির মনির।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, আদালত এখনও গঠন হয়নি। তদন্ত সংস্থায় আগের ৬ জন রয়েছেন। আরও অনেক তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রয়োজন। প্রসিকিউশনে অন্তত ২০-২৫ জন প্রয়োজন। আমরা এখন মাত্র ৫ জন আছি। সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ না করে বিচার শুরুর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে না। সারা দেশে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হবে।

তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের বিষয়ে আইন উপদেষ্টার কাছে দাবি করেছি। প্রয়োজনীয় কাজ আটকে আছে। আইন উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছেন। আশা করছি, আগামী সপ্তাহের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন হবে।

প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম ঢাকা মেইলকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হলে আগে থেকে বিচারাধীন মামলাগুলোর আগে নিষ্পত্তি করা হবে। ৩০টি মামলার বিচার চলমান আছে। এসব মামলার বিচার শেষ করে আসামি বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত আসবে। কেউ সাজাপ্রাপ্ত হতে পারেন। আবার কেউ খালাসও পেতে পারেন। এজন্য বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে এদেরকে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক (প্রশাসন) আতাউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তদন্তের অংশ হিসেবে বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করে আহতদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং চিকিৎসার নথিপত্র সংগ্রহ করেছি। সারা দেশের ডিসি-এসপি, সিভিল সার্জন, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কবরস্থানসহ সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে হতাহতের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছি। এসব তথ্য হাতে এলে তদন্ত দ্রুত শেষ করা যাবে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় চালানো গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্তত ১৯টি অভিযোগ জমা হয়েছে। এরমধ্যে ১৮টি সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় চালানো হত্যার ঘটনায়। বাকি একটি অভিযোগ ২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে চালানো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হত্যায়।

এদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, থানা এবং আদালতে করা প্রায় সব ঘটনাতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সব কেন্দ্রীয় নেতাকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। বাকিরা বেশিরভাগই পলাতক। 

এখন পর্যন্ত যেসব কাজ হয়েছে এই ট্রাইব্যুনালে

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর ৮ (১) ধারা মতে, ২০১০ সালের ২৫ মার্চ তদন্ত সংস্থা গঠিত হয়। ২০১১ সাল ও সর্বশেষ ২০২৩ সালে পুনর্গঠিত তদন্ত সংস্থা তদন্ত কাজ পরিচালনা করেন ২০২৩ সালের ৫ মে পর্যন্ত।

ওইদিন পর্যন্ত ৮৮টি (আটাশি) মামলায় ৩২৫ (তিনশ পঁচিশ) জনের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। তন্মধ্যে ৫২টি (বাহান্ন) মামলায় ১৩৮ (একশত আটত্রিশ) জনের বিরুদ্ধে বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। ৯৩ (তিরানব্বই) জনের বিরুদ্ধে প্রাণদণ্ডাদেশ, ৩৬ (ছত্রিশ) জনের বিরুদ্ধে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় এবং ৬ (ছয়) জনের ২০ (বিশ) বছরের সাজা প্রদান করেন। ২ (দুই) জন খালাস ও ১ (এক) জনের আদেশে নিষ্পত্তি হয়েছে। ৬ (ছয়) জনের প্রাণদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে।

যে প্রেক্ষাপটে গঠন হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের একটি বিষয় ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকার।

১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনেই অভিযুক্তদের তদন্ত এবং বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মূলত ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্যই এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে সংসদ অধিবেশনে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার’ বিষয়ে একটি মৌখিক প্রস্তাব পাস হয়। তবে ২০১০ সালের আগে আইনে কারো বিচার বা সাজা হয়নি।

পরবর্তী সময়ে ট্রাইব্যুনালে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেও বিচারের আওতায় আনা এবং স্বাধীনভাবে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ পরিচালনার বিধান যুক্ত করে আইনে কিছু সংশোধনী আনা হয়। এর মাধ্যমেই ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়।

এআইএম/জেএম